হজ্জ


হজ্জ
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। হজ্জের আভিধানিক অর্থ হল সংকল্প বা ইচ্ছা করা। ইসলামী পরিভাষায় শরীয়তের যথাযথ বিধান অনুযায়ী কা'বা শরীফের যিয়ারতের (দর্শনের) উদ্দেশ্যে গিয়ে নির্ধারিত ইবাদত পালন করাকে হজ্জ বলা হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্তাআলা বলেছেন, "ওয়ালিল্লাহি 'আলান্নাসি হিজ্জুল বায়তি মানিস্তাতাআ ইলায়হি সাবীলা" অর্থাৎ কা'বা গৃহের হজ্জ সেসব লোকের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যারা সেখানে যাবার যোগ্যতা রাখে (সূরা আলে ইমরান : ৯৮ আয়াতাংশ) হযরত রসূলে করীম (সঃ) বলেছেন, "সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি হজ্জ আদায় না করলো সে ইহুদী কি খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করল সে বিষয়ে আমার কোন পরওয়া নেই" (তিরমিযী)
নির্দেশ হতে দেখা যায়, নিম্নে বর্ণিত যোগ্যতার অধিকারীর ওপরেই হজ্জ ফরয করা হয়েছেঃ
() স্বাস্থ্যবান মুসলমান,
() প্রাপ্ত-বয়স্ক বুদ্ধিমান,
() সংসার পরিচালনার পর হজ্জে যাওয়ার মত আর্থিক সংগতি,
() রাস্তার নিরাপত্তা,
() স্ত্রীলোকের জন্যে মাহরিম (যাদের সঙ্গে বিবাহ অবৈধ্য) সঙ্গী।
সূরা বাকারার ২৫ রুকুতে আল্লাহ্তাআলা হজ্জ যাত্রীকে উপযুক্ত পাথেয় সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। স্ত্রীলোকের মাহরিম সঙ্গী না নিয়ে হজ্জ যাত্রা নিষিদ্ধ হওয়ার বিবরণ বুখারী মুসলিম শরীফের হাদীসে দেখতে পাওয়া যায়।

তিন প্রকার হজ্জ
হজ্জ তিন প্রকার-
() তমত্তো-হজ্জের মাসগুলোতে (শাওয়াল, যিলকদ যিলহজ্জ) প্রথমে শুধু উমরাহ্ জন্যে ইহরাম বেঁধে উমরাহ্ পর অর্থাৎ বায়তুল্লাহ্ তোয়াফ সাফা-মারওয়ার মাঝে সাত পাক দেয়ার পর কেশ কর্তন করে ইহরাম খুলে ফেলা, অতঃপর আটই যিলহজ্জ নূতন করে ইহরাম বেঁধে হজ্জের অনুষ্ঠান পূর্ণ করা;
() কিরান-মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) হতে হজ্জ এবং উমরাহ্ উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধা এবং একই ইহরামে হজ্জ উমরাহ সম্পন্ন করা,
() মুফরাদ -মিকাত হতে শুধু হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধা। এতে উমরাহ করতে হয় না।

মানাসিকে হজ্জ বা হজ্জের অনুষ্ঠান-সূচী
() ইহরাম,
() তোয়াফ বা বায়তুল্লাহ্পরিক্রমণ;
() সয়ী বা সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাত পাক দেয়া,
() উকূফে আরাফাত বা আরাফাতে অবস্থান,
() মুজদালিফা মীনাতে অবস্থান,
() রমি করা বা কংকর নিক্ষেপ,
() কুরবানী করা,
() তোয়াফে বিদা প্রভৃতি।
নীচে উক্ত অনুষ্ঠানগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো :

. ইহরাম:
হজ্জের বিশেষ পোশাক সেলাইবিহীন দু'টি চাদর। একটি পরিধান করতে হয় এবং অপরটি গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়। নির্দেশ শুধু পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য। মহিলারা সাধারণ পোষাক পরিধান করতে পারেন, তবে মুখ আবৃত করা নিষেধ। ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা উচিত। ইহরামের জন্যে দু'রাকাআত নামায পড়ার পর নিয়্যত করার বিধান আছে। মুহরিমের জন্যে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যথা-মাথা (শুধু পুরুষের জন্য) মুখ আবৃত করা, সুগন্ধি ব্যবহার, কেশ মুন্ডন, নখ কাটা, শিকার করা, কোন প্রাণী হত্যা করা,ঝগড়া-বিবাদ করা, গালি-মন্দ অথবা বাজে কথা বলা, বিবাহ করা বা বিবাহ পড়ান, সহবাস ইত্যাদি। ইহরাম অবস্থায় উচচস্বরে 'তলবীয়া' পাঠ করতে হয়। তলবীয়ার বাক্যগুলো এরূপ-"লাব্বায়িকা আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারীকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়াল নি'মাতা লাকা ওয়াল মূলকা, লা শারীকালাকা" অর্থাৎ- "উপস্থিত, হে আল্লাহ্‌! আমি উপস্থিত; আমি উপস্থিত, তোমার কোন শরীক নেই, আমি উপস্থিত; নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা এবং অশেষ অনুগ্রহের তুমিই মালিক এবং আধিপত্যেরও (মালিক) তোমার কোন অংশীদার নেই।" ইহরাম, হজ্জ উমরাহর জন্য তলবীয়া পাঠ করা একান্ত জরুরী। হজ্জে ৩টি ফরযের এটা অন্যতম।

. তোয়াফ:
দোয়া সহকারে পবিত্র কা'বা গৃহকে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে 'তোয়াফ' বলে। প্রথম তিন চক্করে দ্রুুত পদক্ষেপ সহকারে এবং কাঁধ দুলিয়ে প্রদক্ষিণ করাকে রমল বলে। প্রথম তোয়াফকে কুদুম বলে। তোয়াফের ক্ষেত্রে হাতিম (কা'বার পরিত্যক্ত স্থান)- কা'বা গৃহের অন্তর্গত। কাবাগৃহের যে কোণে 'হজরে আসওয়াদ' (কালো পাথর) অবস্থিত সেই কোণ হতে তোয়াফ শুরু করতে হয়। প্রতি চক্কর শেষে কালো পাথরকে চুম্বন করতে হয়। চুম্বন করা সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেও চলবে। উলেস্নখযোগ্য, হযরত উমর (রাঃ) একদা তোয়াফ কালে চুম্বন করতে গিয়ে বলেছিলেন, "হে পাথর! আমি জানি তোর ভাল-মন্দ করার কোনই ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমার প্রিয় নবীকে চুম্বন করতে দেখেছি বলে আমিও তোকে চুম্বন করলাম" (বুখারী মুসলিম) হজরে আসওয়াদের পূর্ব কোণকে 'রুকূনে ইয়ামনী' বলে। সেই কোণকেও স্পর্শ বা চুম্বন করা যায়। সাত তোয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমে দু'রাকাআত নামায পড়ার বিধান আছে। ১০ই যিলহজ্জ মীনাতে কুরবানী করার পর ১০, ১১ বা ১২ তারিখের মধ্যে বায়তুল্লাহ্ তোয়াফ করা হজ্জের অন্যতম ফরয। তোয়াফকে "তোয়াফে যিয়ারত" বলে।

. সয়ী:
সাফা পাহাড় হতে শুরম্ন করে মারওয়া পাহাড় পর্যন্ত সাতবার ঘুরে আসাকে 'সয়ী' বলে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি স্থানে হযরত বিবি হাজেরার অনুকরণে দৌড় দিতে হয়। হজ্জ এবং উমরাহ্কারীদের এটাও একটি অনুষ্ঠান। সয়ীর পর যমযমের পানি পান করা সুন্নত।

. উকূফে আরাফাত:
৯ই যিলহজ্জ সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকে 'উকূফ' বলে। সেদিন যুহর আসরের নামায জমা করে দোয়া ইস্তিগফারের মাঝে সময় অতিবাহিত করতে হয়। এটা হজ্জের একটি প্রধান ফরয। রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, "৯ই যিলহজ্জ দিনে অথবা রাত্রে যে এক মুহূর্ত আরাফাতে অবস্থান করেছে তার হজ্জ সম্পূর্ণ হয়েছে।"



. মুজদালিফা মীনাতে অবস্থান:
৮ই যিলহজ্জ হতে ৯ই যিলহজ্জ আরাফতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মীনাতে অবস্থান করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সুন্নত। আবার ১০ই যিলহজ্জ হতে ১২ই অথবা ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত মীনায় থাকতে হয়। আরাফাত হতে মীনায় ফেরার পথে 'মাশারাল হারাম' পাহাড়ের পাদদেশে মুজদালিফা নামক স্থানে রাত্রিযাপন সেখানে মাগরিব ইশার নামায জমা করে পড়ার বিধান আছে।

. রমি করা বা কংকর নিক্ষেপ:
জমারাতুল আকাবা, উলা উসতাতে পাথর নিক্ষেপকে 'রমি' বলে। ১০ই যিলহজ্জ দ্বিপ্রহরের পূর্বে শুধু আকাবাতে এবং ১১ ১২ তারিখে (সম্ভব হলে ১৩ তারিখেও) সূর্য ঢলে পড়ার পর যথাক্রমে উলা, উসতা আকাবাতে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। সাধারণত একে রূপকভাবে শয়তানের উপর পাথর মারা বলা হয়।

. কুরবানী করা:
কিরান তমত্তো হাজীদেরকে প্রথম দিন 'রমি' (প্রস্তর নিক্ষেপ) করার পর ১২ তারিখের মধ্যে মীনায় কুরবানী করতে হয়। কুরবানীর পর মস্তক মুন্ডন করার রীতি আছে। যারা কুরবানী করার সামর্থ্য রাখে না তারা দশটি রোযা রাখবে(সূরা বাকারাঃ ২৪ রুরম্ন দেখুন)

. তোয়াফে বিদা:
বিদেশী হাজীদেরকে মক্কা ত্যাগের পূর্বে শেষ বারের মত কা'বা শরীফের 'তোয়াফ' করতে হয়। বিদায় কালের তোয়াফকে তাই বলা হয় 'তোয়াফে বিদা'


No comments

Powered by Blogger.