রোযা সম্বন্ধে অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়


রোযার আরো কয়েকটি বিশেষ দিক
১। সম্পূর্ণ একমাস রোযা এজন্য রাখতে হয়, যাতে নফ্ দমন হয় এবং মানুষ রূহানীয়ত লাভের যোগ্যতা লাভের পূর্ণ সময় পায়।
২। চাঁদের হিসাবে রোযা রাখার কারণ, যাতে সব মৌসুমেরই অভিজ্ঞতা জন্মে এবং রোযার উদ্দেশ্য বছরে বছরান্তে পূর্ণতা লাভ করতে পারে।
৩। বিশেষ মাসে রোযা রাখার উদ্দেশ্য, সকলেই জাতিগতভাবে একসঙ্গে বিশেষ অনুকূল পরিবেশের মাঝে রোযা রেখে এর পূর্ণ ফায়দা হাসিল করতে সক্ষম।

দান খয়রাত ফিতরানা
রোযার মাস বিশেষ দান খয়রাতের এক সুবর্ণ সুযোগ আনয়ন করে। রোযার সাধনা এবং কৃচ্ছ্রতা মালী কুরবানীর সাথে একত্র হয়ে এক মহান আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি করে। সদ্কা, ফিত্রানা এবং অন্যান্য দান-খয়রাতের দ্বারা সমাজের গরীব-দুঃখী সকলেই মহান সাধনায় অংশ গ্রহণ করতে পারে এবং পবিত্র ঈদের খুশীতে শামিল হতে পারে। জন্যে হাদীসে এসেছে, মাহে রমযানে রসূলে করীম (সাঃ) ঝড়ের গতিতে অনেক বেশি দান খয়রাত করতেন। বস্তুত সকল প্রকার রূহানী সাধনার সাথে মালী কুরবানীর এক মহান ত্যাগজনিত তৃপ্তিতেই পবিত্র মাসের উদ্দেশ্যাবলী পূর্ণ হয় এবং সত্যিকার অর্থে ঈদ দ্বারা এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
ঈদ-উল-ফিতরের সদ্কা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব। নেযারতে বায়তুল মাল এক সা' অর্থে প্রায় পৌনে তিন সের খাদ্য-শস্য সদ্কাতুল ফিতরা (ফিতরানা) অথবা এর মূল্যের সমান ফিত্রানা নির্ধারণ করেছেন। সদ্যজাত শিশুর জন্যেও ফিত্রানা দেয়া ওয়াজিব। ফিত্রানা ঈদের আগেই আদায় করা উচিত, কেননা গরীব রোযাদার যেন ফিতরানার অর্থ দ্বারা রোযা রাখতে সুবিধা পায় এবং ঈদের খুশীতে অংশ গ্রহণ করতে পারে। ফিতরানা দেয়া কারও ওপর কোন প্রকার ইহসান নয়। এটা আমাদের জন্যে ইবাদতের অঙ্গ। এমনকি যে ব্যক্তিকে ফিতরানার সাহায্য দেয়া হয় তার নিজের পক্ষ থেকেও ফিতরানা দেয়া কর্তব্য। যে পুরা হারে ফিতরানা দিতে অক্ষম সে অর্ধহারেও আদায় করতে পারে। সবার অংশগ্রহণের ফলে সদকাতুল ফিতরের ফান্ডটি একটি সাধারণ ফান্ডে পরিণত হয় সুতরাং থেকে যারা উপকৃত হন তাদের হীনমন্যতার কোন কারণ ঘটে না।

তারাবীহ্ নামায
রমযান মাসে ইশার নামাযের পর তারাবীহ নামায পড়তে হয় এবং সাধ্যমত শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাযও পড়তে হয়। তারাবীহ্ নামাযের বিস্তারিত বিবরণ তৃতীয় পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে। সাধারণতঃ বেতরের নামায আট রাকাআত তারাবীহ নামাযসহ ১১ রাকাআত পড়তে হয় (বুখারী, মুসলিম মিশকাত) ইমাম সাইযুতী (রহঃ) লিখেছেন যে, ১১ রাকাআতই লোকের মিলিত মত (ইজমা')

রোযার নিষিদ্ধ দিন
নিম্নোক্ত দিনগুলোতে রোযা রাখা নিষেধ :
. ঈদ-উল-ফিতরের দিন এর পরবর্তী দিন এবং ঈদ-উল-আযহার দিন রোযা রাখা নিষিদ্ধ (মুসলিম)
. ১১, ১২, ১৩ যিলহজ্জ আইয়ামে তাশ্রীকের দিনগুলোতে রোযা রাখা নিষেধ (তিরমিযী)
. সন্দেহের দিন (তিরমিযী)
. রমযানের শুভাগমনের উদ্বোধনে রোযা রাখা নিষেধ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)
. শুধু জুমু'আর দিন রোযা রাখা নিষেধ। পূর্বে অথবা পরে একদিন যোগ করে রোযা রাখা যেতে পারে (বুখারী)
. স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোযা রাখা নিষেধ (বুখারী মুসলিম)

রোযা সম্বন্ধে অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়
১। আল্লাহ্তাআলা কুরআন মজীদে জানিয়েছেন, "ফামান শাহিদা মিনকুমুশ্শাহ্রাফালইয়া সুমহু'' অর্থাৎ রমযান মাসে যে কেউ জীবিত এবং সুস্থ থাকে তার জন্য রমযান মাসে রোযা রাখা ফরয (সূরা বাকারা ১৮৬ আয়াত)

২। বছরের শুধু রমযান মাসের রোযাই ফরয। বাকী অন্যান্য রোযা নফল।

৩। সকল সুস্থ, বুদ্ধিসম্পন্ন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের জন্য রমযানের রোযা রাখা ফরয, রোগী মুসাফীর ছাড়া (সুরা বাকারা ১৮৫ আয়াত) রোগ মুক্তির পর এবং সফর হতে ফেরার পর পরবর্তী বছরের রোযা আসার পূর্বেই সেই রোযাকে পুরা করতে হবে।

৪। রমযান মাস চাঁদ দেখার পর অথবা অধিকাংশ লোকের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পাওয়ার পর অথবা শা'বান মাসের ত্রিশ দিন পার হবার পর দিন হতে রোযা শুরু হয়ে যায়। যদি ২৯ শে শা'বান আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার জন্য কয়েকজন লোক চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয় এবং তা ন্যায়সম্মত সাক্ষ্য হলে পরদিন হতে রোযা শুরু করতে হবে (মুসনাদ ইমাম আহমদ হাম্বল এবং অন্যান্য হাদীস)

৫। প্রত্যক দিন রোযার নিয়্যত সুবেহ সাদেকের পূর্বে করতে হবে অর্থাৎ বলতে হবে যে, শুধু আল্লাহ্ জন্য আমি আজকের রোযা রাখছি। (আহমদ, আবূ দাউদ তিরমিযী) রোযার জন্য নিয়্যত করা জরুরী।

৬। নফল রোযা শাওয়ালের তারিখ হতে তারিখ দিন রাখা যায়। ছাড়া হযরত রসূলে করীম (সাঃ) প্রত্যেক চান্দ্র মাসে ১৩, ১৪,১৫ তারিখে নফল রোযা রাখতেন। যে মুসলমান যুবক দরিদ্রতাবশতঃ বিয়ে করতে অক্ষম তার জন্য প্রয়োজন মত নফল রোযা রাখা খুবই উপকারী। এতে নফস দমন হয়ে চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা হয়।

৭। রোযা রাখার জন্য সুবেহ সাদেকের পূর্বে সেহরী খেতে হয় (বুখারী) অতঃপর সারাদিন সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বন্ধ রাখতে হয় এবং সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস পরিত্যাগ করার নাম রোযা (সূরা বাকারা ১৮৮ আয়াত) সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই রোযা খুলতে তাড়াতাড়ি করা এবং সেহ্রী দেরী করে খাওয়া হযরত রসূলে করীম (সাঃ) পছন্দ করতেন (তিরমিযী, আবূ দাউদ)

৮। মাথায় পানি দিলে, খুশবু লাগালে, অনিচ্ছাসত্ত্বে বমি করলে, মাথায় তেল দিলে, আয়না দেখলে, মেছওয়াক করলে, শরীর মর্দন করলে রোযা ভঙ্গ হয় না (সুরমা ব্যবহার মাকরুহ) (দারকুতনী, তিরমিযী, ইবনে মাজা, বুখারী মুসলিম) ভুলবশতঃ কেউ রমযানে পানাহার করলে তার রোযা কাযা করতে হয় না। রোযা থেকে ভুলবশতঃ যদি কেউ পানাহার করে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে কেননা, আল্লাহ্তাআলা তাকে আহার পান করিয়েছেন, (বুখারী মুসলিম)
খাদ্যবস্তু এবং অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে একটি মুলনীতি হযরত ইবনে আব্বাস কর্তৃক এরূপে বর্ণিত হয়েছে : (ইচছাকৃতভাবে) শরীরে প্রবেশ করানো হয় এরূপ বস্তু দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয় এবং (অনিচছাকৃতভাবে) শরীর হতে বের হয় এরূপ বস্তু দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না। কুলির পানি অজ্ঞাতসারে গিল্লেও রোযা নষ্ট হয় না। যদি জানা যায় যে, খাওয়ার সময় প্রভাত হয়ে গিয়েছিল বা যখন ইফতার করা হয়েছিল তখন সূর্য অস্ত যায় নি তা হলে সে রোযা হয় না, কাযা করতে হবে ( বুখারী)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, রসূলে করীম (সাঃ) অগোছল অবস্থায় থেকে প্রভাত হলে পরে (ফজরের নামাযের পূর্বে) গোসল করতেন এবং রোযা রাখতেন (বুখারী মুসলিম)

৯। যদি কেউ রমযান মাসে সফরে যায় অথবা রোগাক্রান্ত হয় অথবা রোযা অবস্থায় প্রাণহানির আশঙ্কাজনক ক্ষুধা-পিপাসার অবস্থা হয়, তা হলে রোযা ভঙ্গ করতে হবে। মেয়েদের জন্য হায়েয এবং নেফাসের অবস্থায় রোযা রাখা নিষেধ। সব লোককে অন্য সময় রোযা পুরা করতে হবে (পরবর্তী বছর রোযা আসার পূর্বেই)

১০। চিররোগী এবং অতিবৃদ্ধ যারা রোযা রাখতে অক্ষম তাদেরকে প্রত্যকদিন কোন সহায় সম্বলহীন গরীব ব্যক্তিকে 'ফিদিয়া' হিসেবে দু'বেলা খাওয়ানোর সুব্যবস্থা করতে হবে। সন্তানকে স্তন্যদানকারী স্ত্রীলোক অথবা গর্ভবতী স্ত্রীলোক যদি নিজে দুর্বল মনে করে এবং এটা মনে করে যে, সারা বছর উক্ত রোযা পুরাও করতে পারবে না তা হলে 'ফিদিয়া' দেয়াই উত্তম।

১১। যে ব্যক্তি রমযানের রোযায় কারও অনুরোধে অনিচছা সত্ত্বেও পানাহার করে অথবা স্ত্রী-সহবাস করে তা হলে তার রোযা ভেঙ্গে যায়। এর 'কাফফারা' দিতে হবে অর্থাৎ যতগুলি রোযা ভাঙ্গবে পরবর্তীতে ততগুলিই রোযা রাখতে হবে।

১২। সূর্যাস্ত হওয়ার পর এবং মাগরিবের নামাযের পূর্বে দোয়া পড়ে ইফতার করতে হবে : আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়াবিকা আমানতু ওয়া 'আলা রিযকিকা আফতারতু অর্থ্যাৎ হে আল্লাহ্‌! তোমার জন্যই আমি রোযা রেখেছি, তোমার উপর ঈমান এনেছি এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করছি (আবূ দাউদ)

১৩। খেঁজুর অথবা ঠান্ডা পানি দিয়া ইফতার করা সুন্নত। অন্যদেরকে ইফতার করানো খুবই পুন্যের কাজ।

১৪। যে কেউ আল্লাহ্ সন্তোষ্টি লাভের জন্যে একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ্তার নিকট হতে দোযখকে এত দূরে রাখবেন, যতদূর একটি কাক অতি বৃদ্ধ কাল পযন্ত উড়ে যেতে পারে (আহমদ, বাইহাকী) যে ব্যক্তি রমযানে রোযা রাখে এরপর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখে, সে যেন সারা বছর রোযা রাখলো (মুসলিম)

১৫। সারা বছর রোযা রাখা উচিত নয় (বুখারী) সারা বছর রোযা রাখলে অন্যান্য অসুবিধা ছাড়াও রোযার যে উদ্দেশ্য তা ব্যাহত হয়। কারণ, তখন রোযা রাখা শরীরের পক্ষে এমনভাবে অভ্যাস হয়ে যায় যে, রোযার ফলে যে বিশেষ উত্তাপ দহন সৃষ্টি হওয়ার কথা, তা 'তে পারে না। ফলে আত্মশুদ্ধি এবং রোযার অন্যান্য উপকারিতা লাভ করা সম্ভব হয় না।

১৬। সহী হাদীসে আছে, যখন রমযান মাস আসে তখন বেহেশতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয় এবং মু'মিনের জন্যে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ হয়। শয়তানদিগকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়। রোযা মুমেনের ঢালস্বরূপ। যে মিথ্যা কথা এবং তদনুযায়ী কাজ ত্যাগ করে না তার খাদ্য বা পানীয় ত্যাগ করার মাঝে আল্লাহ্ কোন আবশ্যকতা নেই। রমযান মাসে এক মহামান্বিত রাত আছে যা এক হাজার মাস হতে উত্তম। যাকে হতে বঞ্চিত করা হয়েছে সে সর্বপ্রকার মঙ্গল হতে বঞ্চিত এবং দুর্ভাগা। পরিশেষে রোযা রাখার গুরুত্ব সম্বন্ধে হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ
"যার অন্তর কথায় আনন্দিত যে, রমযান এসেছে এবং সে প্রতীক্ষায় ছিল রোযা এলেই রাখবে, অথচ অসুস্থতার জন্যে রোযা রাখতে পারে না এরূপ ব্যক্তি আকাশে রোযা হতে বঞ্চিত হবে না। দুনিয়ার অনেক লোক বাহানা খুঁজে এবং ভাবে যে, দুনিয়ার মানুষকে আমি যেরূপ ধোঁকা দিচ্ছি সেভাবে খোদাকেও ধোঁকা দিচিছ। বাহানাকারী নিজের পক্ষ হতে মসলা বানিয়ে নেয় এবং ওজরগুলোকে শামিল করে মসলাগুলোকে সহী সাব্যস্ত করে। কিন্তু খোদার নিকট সেগুলো সহী নয়। ওজর বাহানার দরজা খুবই বিস্তৃত। মানুষ চাইলে দিয়ে সারা জীবন বসে নামায পড়তে পারে এবং রোযা একেবারেই না রাখতে পারে। কিন্তু খোদা তার নিয়্যত ভাবধারা অবগত যার সততা আন্তরিকতা আছে। খোদা জানেন যে, তার অন্তরে দরদ রয়েছে। খোদা তাকে আসল পুণ্য হতে অধিক দান করেন। কারণ, মর্ম-বেদনা মর্যাদার বিষয়। বাহানাকারী ব্যাখ্যার উপর ভরসা করে কিন্তু আল্লাহ্তাআলার নিকট ভরসার কোন মূল্য নেই।"
(আল্হাকাম, ১০/১২/১৯০২, পৃঃ )


No comments

Powered by Blogger.