রোযা
রোযা
ইসলামী ইবাদতের দ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ হলো সিয়াম বা রোযা পালন। চান্দ্র বছরের নবম মাসের নাম 'রমযান'। রমযান মাসের পূর্ব নাম ছিল নাতেক (কাদীর)। রমযান শব্দটি 'রময' মূল ধাতু হতে এসেছে। এর অর্থ পিপাসায় উত্তপ্ত হওয়া। হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) এ সম্বন্ধে বলেছেন, "আরবী ভাষায় সূর্যের তাপকে রম্য বলা হয়। যেহেতু রমযান মাসে রোযাদার পানাহার ও যাবতীয় দৈহিক ভোগ-বিলাস হতে বিরত থাকে এবং আল্লাহ্র আদেশসমূহ পালন করার উদ্দেশ্যে নিজের প্রাণের ব্যগ্রতার তাপ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, সেজন্য এ আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক উভয় প্রকার তাপের সংমিশ্রণে রমযান হয়েছে। আভিধানিকগণ বলে থাকেন, রমযান গ্রীষ্মকালে এসেছিলো বলে একে 'রম্যান' বলা হয়েছে। আমার মতে এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা, আরব দেশের জন্যে এতে কোন বিশেষত্ব থাকতে পারে না। আধ্যাত্মিক তাপের অর্থ আধ্যাত্মিক অনুরাগ ও ধর্ম-কর্মে উদ্দীপনা। 'রময' এমন উত্তাপকেও বলা হয় যাতে পাথর প্রভৃতি পদার্থ উত্তপ্ত হয়" (আল্ হাকাম, ২৪শে জুলাই, ১৯০১ইং)।
সামগ্রিকভাবে এ মাসের নামকরণের কারণসমূহ নিম্নরূপ:
ক. এ মাসে রোযা রাখার ফলে পিপাসার জন্যে উত্তাপ ও দহনের সৃষ্টি হয়।
খ. এ মাসের ইবাদতসমূহ মানুষের দেহ হতে পুঞ্জীভূত সূক্ষ্ণ পাপ রাশিকে দূরীভূত করে;
গ. এ মাসের ইবাদতসমূহ মানুষের হৃদয়ে এমন এক ভালোবাসা এবং অনুরাগের উত্তাপ সৃষ্টি করে যদ্বারা সে ঐশী-প্রেম ও মানব-প্রেমের দীক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয় [তফসীরে সগীরের সূরা বাকারা : ১৮৬ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য]।
হযরত রসূলে করীম (সাঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছর মুসলমানদের ওপর রোযা ফরয করা হয়। রমযানের ইতিহাস, নিয়ম-কানুন, উদ্দেশ্য এবং আদর্শ সম্বন্ধে আল্লাহ্তা'আলা কুরআন করীমে সূরা বাকারার ২৩ রুকূতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
বিশেষত্ব
রমযানুল মোবারকের কতগুলো বিশেষত্ব নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১। রোযার হকীকত (তাৎপর্য):
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) রোযার হকীকত সম্বন্ধে লিখেছেন "অল্প আহার এবং ক্ষুধা সহ্য করাও আত্মশুদ্ধির জন্যে আবশ্যক। এতে দিব্য-দর্শন শক্তি (কাশ্ফী-তাকত) বৃদ্ধি পায়। মানুষ শুধু খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে না। যে অনন্ত জীবনের প্রতি লক্ষ্য করা একেবারেই পরিত্যাগ করে, সে নিজের ওপর "ঐশীকোপ" (কহরে ইলাহী) আনয়ন করে। কিন্তু রোযাদারকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, রোযার অর্থ শুধু এটা নয় যে, মানুষ অনাহারে থাকবে; বরং খোদার যিক্র অর্থাৎ তাঁর স্মরণে মশগুল থাকা উচিত। আঁ হযরত (সাঃ) রমযান শরীফে অনেক বেশি ইবাদত করতেন। এ দিনগুলোতে পানাহারের চিন্তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্তা'আলার প্রতি মনোনিবেশ (তাবাত্তুল ইলাল্লাহ্) করা চাই। দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির, যে দৈহিক প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ করে কিন্তু আধাত্মিক খাদ্যের জন্যে পরওয়া করে না। বাহ্যিক খাদ্যে দৈহিক শক্তি লাভ হয়, একইভাবে আধ্যাত্মিক খাদ্য আত্মাকে কায়েম রাখে এবং এতে আত্মার শক্তিগুলো সতেজ হয়। খোদার নিকট সাফল্য চাও। কারণ, তিনি সামর্থ্য দিলেই সকল দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।"
আহারে দেহ শক্তিশালী হয় এবং রোযার মাধ্যমে অনাহারের ফলে আত্মা শক্তিশালী হয়। জড় অনাহারকে যিক্রে ইলাহী দিয়ে পূরণ করতে হয়। কারণ, যিক্রে ইলাহী আত্মার খোরাক। জড়খাদ্য ও ভোগবিলাসে আত্মা মৃতবৎ হয়ে যায় এবং রোযার মাধ্যমে যিক্রে ইলাহীতে আত্মা জাগ্রত, সতেজ ও ঐশী শক্তিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) আরো বলেছেন, "কেবল অভুক্ত এবং পিপাসার্ত থাকাই রোযার উদ্দেশ্য নয় বরং এর একটি তাৎপর্য এবং প্রভাব আছে যা অভিজ্ঞতায় বোঝা যায়। মানুষের প্রকৃতির মাঝেই এটা নিহিত আছে যে, মানুষ যত কম খায় ততই তার আত্মশুদ্ধি এবং কাশ্ফী তাকত বা দিব্য-দর্শন শক্তি বৃদ্ধি পায়। খোদার অভিপ্রায় এটাই যে, একটি খাদ্যকে কম করে অপর একটি খাদ্যকে বর্ধিত করা। রোযাদারের সর্বদাই এর প্রতি দৃষ্টি দেয়া কর্তব্য। খোদাতাআলার যিক্র বা স্মরণেই সময় কাটানো উচিত যেন সংসারের মোহ দূর হয় এবং আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করা যায়। অতএব, রোযার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এক খাদ্য ত্যাগ করে অন্য খাদ্য গ্রহণ করে। এ আত্মার প্রশান্তির এবং তৃপ্তির কারণ হয়। যে লোক শুধু খোদার জন্যেই রোযা রাখে এবং আচার-অনুষ্ঠানের রোযা রাখে না তার উচিত, যেন সর্বদা হামদ (প্রশংসা কীর্তন), তসবীহ্ (আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য ঘোষণা) এবং তাহ্লীলের (আল্লাহ্র তৌহীদ ঘোষণা) মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যাতে তার দ্বিতীয় খাদ্যের (আধ্যাত্মিক খাদ্যের) সৌভাগ্য লাভ হয় (আল্ হাকাম ১৭/০১/১৯০৭)।
আল্লাহ্তাআলা অনাহারী। আমরা রোযা রেখে অনাহারী থাকায় যেমন আল্লাহ্তাআলাকে অনুসরণ করি, তেমনি যিক্রের মাধ্যমে তাঁর গুণাবলীকে স্মরণ করে সেগুলোকেও আমাদের চরিত্রে নকল ও প্রতিফলিত করার সুযোগ দানই হলো রোযার বিধানের উদ্দেশ্য। ঐশী-বিধানসম্মত রোযা মানুষকে ঐশী-রঙে রঞ্জিত করে। হযরত রসূল করীম (সাঃ) বলেছেন, "আল্লাহ্তাআলা বলেন, "প্রত্যেক নেকীর জন্য আমি কোন না কোন বস্তুর আকারে পুরস্কার নির্ধারিত করেছি। কিন্তু রোযার পুরস্কার আমি স্বয়ং।" এর অর্থ এই যে, সফল রোযাদারের মাধ্যমে আল্লাহ্তাআলা স্বীয় জ্যোতিঃ ও শক্তির বিকাশ করে থাকেন।
হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) রোযার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেনঃ "আমাদের দেহে দৈনিক যে রূহানী বিষ সৃষ্টি হয় তা দূর করার জন্যে আল্লাহ্তা'আলা একটি ব্যবস্থা করেছেন এবং সারা বছর যে বিষ জমা হয়, তা দূর করার জন্যে আর একটি ব্যবস্থা করেছেন অর্থাৎ দৈনিক যে আধ্যাত্মিক বিষ সৃষ্টি হয় তা দূর করার জন্যে তিনি দৈনিক পাঁচ বারের নামাযের ব্যবস্থা করেছেন এবং সারা বছর যে বিষ জমা হয় তা দূর করার জন্যে রমযানে এক মাসের রোযা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। রোযা না রাখার ফলে বছরব্যাপী পুঞ্জীভূত বিষ বাড়তেই থাকে এবং এর ফলে সেই ব্যক্তির মাঝে এরূপ কাঠিন্য এবং এরূপ দৃষ্টিহীনতার সৃষ্টি হয় যে, খোদাতা'আলা তার সম্মুখে এলেও তাকে সে চিনতে পারে না। যেমন কোন ব্যক্তি দৃষ্টি-শক্তি হারালে তার অত্যন্ত নিকট-আত্মীয় সম্মুখে দাঁড়ালেও সে তাকে দেখতে পারে না। অনেকে মনে করে যে, তারা রোযা রেখে খোদার বড়ই ইহসান (উপকার) করেছে। এরূপ মনে করার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই নেই। চিকিৎসক কোন রুগীর চিকিৎসার প্রয়োজনে রক্তক্ষরণ করলে যদি সে রুগী মনে করে যে, সে রক্ত দিয়ে ডাক্তারের বড়ই উপকার করেছে তা হলে তার অপেক্ষা বড় মূর্খ আর কে আছে? ঔষধ যতই তিক্ত হোক তা রুগীর জন্যে কল্যাণজনক। তদ্রুপ যখন কেউ রমযান মাসে রোযা রাখে, তখন সে খোদাতাআলার উপর ইহসান করে না বরং এটা তার উপর খোদাতাআলার ইহসান যে, তিনি এরূপ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সুতরাং এ মাসের প্রতি সম্মান দেখানো আমাদের বিশেষ কর্তব্য। আমরা এ দিনগুলোকে যত বেশি সদ্ব্যবহার করবো, আমাদের অন্তরের পুঞ্জীভূত বিষ ততই দূর হয়ে যাবে যেগুলো ভিতরে ভিতরে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছিল" (আল্ ফযল ১৯-১২-১৯৬৫ ইং)।
হযরত খলীফতুল মসীহ সালেস (রাহেঃ) রমযানের ইবাদত সম্বন্ধে বলেনঃ- "মাহে রমযান পাঁচটি ইবাদতের সমষ্টি। প্রথমটি হলো রোযা রাখা, দ্বিতীয়- ফরয নামায ছাড়াও রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ রাত্রে নফল ইবাদতসমূহ (তারাবীহ, তাহাজ্জুদের নামায ইত্যাদি) আদায় করা এবং বিনয়ের সাথে নিজ প্রভুর নিকট সর্বপ্রকারের মঙ্গল কামনা করা। তৃতীয়- বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা। চতুর্থ- দান-খয়রাত করা এবং পঞ্চম-প্রবৃত্তির কু-প্ররোচনা হতে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করা।"
২। রোযার ঐতিহাসিক দিক:
(ইয়া আইয়্যূহাল্লাযীনা আমানূ কুতিবা 'আলায়কুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা 'আলাল্লাযীনা মিন কাবলিকুম লা'আলল্লাকুম তাত্তাকূন)
অর্থ-হে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর রোযা বিধিবদ্ধ করা হলো, যেরূপে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর এটা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো (সূরা বাকারাঃ১৮৪)।
(ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা-হে যারা, আমানূ-ঈমান এনেছো, কুতিবা-বিধিবদ্ধ করা হলো, সিয়ামা-রোযা, কামা-যেরূপে, মিন-হতে, কাবলিকুম-তোমাদের পূর্ববর্তী, লা'আল্লাকুম-যাতে তোমরা, তাত্তাকূন-তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো)]
রোযাকে ফরয করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্তাআলা ঐতিহাসিক এবং মনস্ততাত্ত্বিক দিক সম্বন্ধেও ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, এ রোযার হুকুম কোন অভিনব ব্যাপার নয় এবং এতে কোন সহ্যাতীত কষ্টও নেই। ধর্ম-ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, বিশ্বের সকল ধর্মেই রোযা অবশ্য-পালনীয় ব্যবস্থা ছিল। ইহূদীরা হযরত মূসা (আঃ)-এর অনুবর্তিতায় রোযা পালন করে। বাইবেলে হযরত মূসা (আঃ) সম্বন্ধে লিখিত আছেঃ "সেই সময় মোশী (মূসা) চলিস্ন্লশ দিবারাত্র সেথা সদা প্রভুর সাথে অবস্থান করলেন, পানাহার করলেন না। আর তিনি সেই দুই প্রস্তরে নিয়মের বাক্যগুলো অর্থাৎ দশ আজ্ঞা লিখলেন (যাত্রা পুস্ত্তক, ৩৪:২৮)।
হযরত ঈসা (আঃ) রোযা রাখতেন এবং তার অনুবর্তিতায় খৃষ্টানরা রোযা পালন করে। ইঞ্জিলে আছেঃ "তখন যীশু দিয়াবল (শয়তান) দ্বারা পরীক্ষিত হবার জন্যে আত্মা দ্বারা প্রান্তরে নীত হলেন। আর তিনি চল্লিশ দিবারাত্র অনাহারে থেকে শেষে ক্ষুধার্ত হলেন" (মথি,৪:২-৩)। এভাবে দেখা যায় যে, মিশরীয়দের মাঝেও রোযার প্রচলন ছিল। গ্রীকরা রোযা রাখত এবং হিন্দু ধর্মে উপবাস ব্রত প্রচলনের ব্যবস্থা আছে। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে Fasting শীর্ষক অংশে লেখা আছে : By the
greater number of religion in the lower middle and higher cultures alike
fasting is largely prescribed অর্থাৎ সভ্যতার নীচ, মধ্য এবং উচ্চ পর্যায় নির্বিশেষে অধিকাংশ ধর্মেই উপবাসের (রোযার) প্রচলন রয়েছে। উল্লেখ্য যে, একমাত্র ইসলাম ধর্মই রোযার নিয়ম কানুন এবং গুরুত্ব সম্বন্ধে পূর্ণরূপে নির্দেশ দিয়েছে এবং একে এক স্থায়ী ও নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে।
৩। তাক্ওয়ার পথ:
রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো 'লা'আল্লাকুম' তাত্তাকূন (সূরা বাকারাঃ ১৮৪) অর্থাৎ রোযার বিধান এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, রোযা রেখে যেন রোযাদারের মাঝে নিষ্ঠা এবং উত্তম চরিত্র জন্মে। সুতরাং কেউ যদি রোযা রেখে এ ফল না পায়, তবে বুঝতে হবে যে, সে রোযার তাৎপর্য বুঝে নি এবং সে সঠিকভাবে রোযা পালন করে নি। প্রকৃতপক্ষে সে রোযা রাখে নি শুধু উপবাস ছিল এবং তার উপবাস থাকা আল্লাহ্তা'আলার অভিপ্রেত ছিল না। একজন বুদ্ধিমান সাবালক এবং সুস্থ মুসলমান প্রভাত হতে সূর্যাস্ত পযর্ন্ত পানাহার, যৌন-সম্পর্ক, মিথ্যা, গালি-গালাজ, পরনিন্দা, পরচর্চা (গীবত) এবং সকল প্রকার মন্দ কাজ হতে বিরত থাকে, এ সময়ে কুরআন পাঠ এবং এর অর্থ অনুধাবনে ব্রতী থাকে, ফরয নামাযসহ তারাবীহ্ এবং তাহাজ্জুদ নামায আদায় করে, দীন-দরিদ্রের সেবা করে এবং ভক্তিপস্নুত হৃদয়ে যিক্রে ইলাহী বা খোদার স্মরণে মশগুল থাকার চেষ্টা করে। কেবল এ সমুদয় বিষয় দ্বারা সিয়াম (রোযা) এবং তাক্ওয়ার অর্ন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। রমযানের মহা বরকতপূর্ণ দিবসগুলোতে রোযাদারের চিত্ত এবং দেহের প্রতিটি অংশ কার্যতঃ অনুভব করতে থাকে যে, তার মাঝে রোযার ফলে এক প্রকার বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হচেছ। এভাবে রোযায় ইসলাহে নফ্স বা আত্মশুদ্ধি হয়ে থাকে।
৪। আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দৈহিক সংযম:
প্রতি বছর রোযা আমাদের নিকট ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণরূপে এসে থাকে। মাহে রমযানে নির্দিষ্ট সময়ে রোযা রাখতে হয়, নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করতে হয়, তারাবীহ্ এবং তাহাজ্জুদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। পিপাসা এবং ক্ষুধার জন্যে মানুষের অনুভব শক্তি সতেজ হয়, ফলে তার বিবেক বুঝতে পারে যে, জাতির সেসব দরিদ্র এবং অনুন্নত ব্যক্তিদের অবস্থা কীরূপ যাদের খাওয়ার পয়সা নেই; যেমন, এতীম এবং বিধবাদেরকে কত কী যে সহ্য করতে হয়। রোযাদার যদি চেতনাশীল হয় তাহলে সে সহজে বুঝতে পারে যে, মানবতার কত বড় শিক্ষা রয়েছে এ রোযার মাঝে! সকল শ্রেণীর লোকের মাঝে ঘনিষ্ঠতা, ঐক্য, সাম্য, প্রেম, হৃদ্যতা, শৃংখলাবোধ, পরিশ্রম, কষ্ট-সহিষ্ণুতা, অনুবর্তিতা, উত্তম ব্যবহার, সৌজন্য, সংযম এবং সর্বোপরি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা এ সমুদয় বিষয়ের জন্যে মাহে রমযানে পবিত্র সাধনা বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ রোযার মাধ্যমে মিথ্যা অহংকার, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রবঞ্চনা, মিথ্যাবাদিতা, অপব্যয়, নেশাপ্রিয়তা, পাষাণ-চিত্ততা, নির্লজ্জতা ইত্যাদি কদাচারসমূহ সমাজ দেহ হতে বিধৌত হয়ে শুধু ব্যক্তি চরিত্রই নয়, জাতীয় চরিত্রেরও উন্নতি সম্ভবপর হয়। কিন্তু রোযা রেখে যদি অসৎ কাজ পরিহারের প্রচেষ্টা না থাকে এবং সদ্গুণ অর্জনের উদ্যম না থাকে তাহলে সেই রোযা রাখা নিরর্থক।
এ সম্পর্কে হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) বলেছেন, "অনেক লোক ছোট ছোট কষ্টে ভীত হয়। এ শ্রেণীর লোকও সারা মাস রোযা রাখে এবং কষ্ট করে। এতে তারা প্রমাণ করে যে, তারা উপবাস করতে এবং এর কষ্ট সহ্য করতে সক্ষম। এরূপে তাদের কষ্ট স্বীকার করার অভ্যাস হয়ে যায়। অতএব এ শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, দ্বীনের খেদমতের জন্যে অধিকরতর উদ্যমী হওয়া আবশ্যক এবং কষ্ট দেখে ভীত হওয়া উচিত নয়। লক্ষ্য করা উচিত যে, কাজ করার সংকল্প বা নিয়্যত করা ও না করার মাঝে কত প্রভেদ রয়েছে। রমযান মাসে নিয়্যত করা হয় যে, রোযাদার দিবাভাগে ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করে। কিন্তু অন্য সময়ে এ নিয়্যত থাকে না বলে তখন দু'ঘন্টার ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করা যায় না। সুতরাং নিয়্যত বা সংকল্পের দ্বারা বড় বড় কাজ করা সম্ভব। অনুরূপভাবে আমাদের নিয়্যত এবং সংকল্পকে এভাবে দৃঢ় করে নেয়া উচিত, যেন আমরা খোদার ধর্ম প্রচারে কোন ত্রুটি না করি এবং ধর্মের বিষয়ে কোন কষ্টকে কষ্ট বলে মনে না করি (দৈনিক আল্ ফযল, ১২-২-১৯৬৪)।
খোদার জন্যে এবং তার ধর্মের জন্যে যাদের হৃদয়ে ভালোবাসা আছে এবং যারা শুধু দুনিয়ার ভালোবাসায় আত্মহারা হয়নি তাদের জন্যে এরূপ সংকল্প গ্রহণ করার মহান শিক্ষা রয়েছে রমযানের-ত্যাগ তিতিক্ষা এবং অনুপম সাধনার মাঝে।
৫। রমযানে কুরআন পাঠের গুরুত্ব:
রমযানে কুরআন পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ্তাআলা বলেনঃ
শাহ্রু রামাযানাল্লাযী উন্যিলা ফীহিল্ কুরআন (সূরা বাকারা : ১৮৬ আয়াতাংশ)
অর্থাৎ রমযান সেই মাস যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে কুরআন।
(শাহরু-মাস, উন্যিলা-অবতীর্ণ করা হয়েছে, ফীহি-এতে)
রমযান মাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হলো, এ পবিত্র মাসে কুরআন করীম নাযিল করা হয়েছিল। আর প্রতি বছর এ মাসে হযরত জীব্রাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট বছরের অন্যান্য সময়ে এবং পূর্বে যতোখানি কুরআন অবতীর্ণ হতো রমযানে তা পুনরাবৃত্তি করা হতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের শেষ বছরের রমযান মাসে হযরত জীব্রাইল (আঃ) তাঁর নিকট দু'বার প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কুরআন করীম আবৃত্তি করেন (বুখারী)। এতে তিনি বুঝতে পারেন যে, কুরআন করীম নাযেল সমাপ্ত হয়েছে।
এ পবিত্র মাসে রোযার কল্যাণ, আজ্ঞানুবর্তিতা এবং কুরআন পাঠ-এসব ইবাদত একত্রে মানবচিত্তে এক আশ্চর্য আধ্যাত্মিক অবস্থা সৃষ্টি করে। আঁ হযরত (সঃ) বলেন, "রমযান ও কুরআন বান্দার জন্যে সুপারিশ করবে। রোযা বলবে খোদা, আমি তাকে পানাহার এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিবৃত্ত রেখেছি এ জন্যে তুমি তার জন্যে আমার সুপারিশ কবুল করো। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি এবং তাকে শুইতে দেই নি এ কারণে তার জন্যে আমার সুপারিশ কবুল করো। তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে (বাইহাকী)।"
রোযা রেখে কুরআন করীম পাঠ করা এবং এর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করা ও এর অনুশাসনাদি পালন করার মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক দর্শনশক্তি সতেজ হয় এবং সে শয়তানি খেয়াল ও প্রভাব হতে নিরাপদ থাকে। অধিকন্তু মানুষ এক অনাবিল আধ্যাত্মিক শান্তি এবং পরম সম্পদ লাভ করে যা শুধু অভিজ্ঞতায়ই উপলব্ধি করা যায় ভাষা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সুনিয়ন্ত্রিত সুখাদ্য যেমন দেহকে সুস্থ,সবল ও আনন্দময় করে তেমনি সুনিয়ন্ত্রিত ইসলামী রোযা আত্মাকে সুস্থ, সতেজ ও উর্ধ্বগামী করে। বস্তুত মাহে রমযানের পবিত্র দিনগুলো বড়ই বরকতপূর্ণ। যে নিতান্তই দুর্ভাগা এবং অপরিণামদর্শী, একমাত্র সে-ই এ কল্যাণ হতে নিজেকে বঞ্চিত রাখে এবং অন্যান্য দিনের মতই পানাহারে মত্ত থাকে।
৬। আল্লাহ্র নৈকট্য এবং দোয়ার কবুলিয়্যত:
যখন রোযার মাধ্যমে বান্দার হৃদয় বিগলিত হয় এবং তার পার্থিব লালসাগুলো স্তিমিত হয়ে আসে, তখন তার আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহ বিকাশ ও পরিবর্ধন লাভ করতে থাকে এবং তার আত্মা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বান্দার এ অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে আল্লাহ্তাআলা বলেন :
(ওয়া ইযা সাআ-লাকা ইবাদী আন্নী ফাইন্নি কারীব, উযীবু দা'ওয়াতাদ্দা'য়ে ইযা দা'আনে, ফাল ইয়াসতাজীবু লী ওয়াল ইউমিনু বী লা'আল্লাহুম্ ইয়ারশুদূন)।
অর্থ :
এবং যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে তখন (বলো), 'আমি নিকটে আছি।' আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দেই যখন সে আমার নিকট প্রার্থনা করে। সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার উপর ঈমান আনে যাতে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় (সূরা বাকারা : ১৮৭)।
আল্লাহ্তাআলার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁর বিধান অনুযায়ী রোযা রাখলে দোয়া কবুল হয়ে থাকে। আল্লাহ্তাআলা বান্দার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন। সেজন্যে কোন বিপদ-আপদে পড়লে এ আদেশের অনুশীলনে রোযা রেখে দোয়া করলে বিপদ কেটে যায়।
৭। হারাম জিনিস পূর্ণরূপে বর্জনের শিক্ষা:
মাহে রমযানে মুসলমানরা আল্লাহ্তা'আলার নির্দেশে সাময়িকভাবে হালাল খাদ্য-বস্তু এবং কামনা-বাসনাকে পরিহার করে। তাদের হাতের কাছে সকল উপভোগ্য বস্তু থাকা সত্ত্বেও তারা সেগুলো ভোগ করে না। একমাস ধরে এ সাধনা চলতে থাকে। এ সাধনার ফলে সে এ শিক্ষা লাভ করতে পারে যে, আল্লাহ্র আদেশে সে যদি হালাল দ্রব্যসমূহ পরিত্যাগ করতে পারে তা হলে সে সব জিনিস এবং লোভ-লালসাকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিত্যাগ করা উচিত যেগুলো আল্লাহ্তা'আলার নিষেধ করেছেন? সেজন্য আল্লাহ্তাআলা রোযা সংক্রান্ত্র বিষয়ের পরেই বলেন : "তোমরা জেনে-শুনে একে অন্যের মাল (ধন-সম্পদ) অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং অন্য লোকের সম্পত্তির কোন অংশ আত্মসাৎ করার জন্যে শাসন কর্তৃপক্ষকে কিছু (ঘুষ) দিও না" (সূরা বাকারা :১৮৯)। এ আয়াতে রোযার ফলে সমাজ কীভাবে উপকৃত ও দোষমুক্ত হতে পারে এর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ই'তিকাফের গুরুত্ব
রমযানের ২০ তারিখ ফজরের নামাযের পর থেকে শুরু করে দশদিন "ই'তিকাফ" করা সুন্নত। "ওয়া আন্তুম আকিফুনা ফিল মাসাজিদ" (সূরা বাকারাঃ ১৮৮)। মু'তাকিফ (ই'তিকাফকারী ব্যক্তি) মসজিদের নিভৃত কোণে পর্দার অন্তরালে বসেন, কুরআন করীম পাঠ করেন, খোদার স্মরণে নিমগ্ন থাকেন,বাজে কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। আবূ দাউদ হাদীসে আছে "ই'তিকাফের দিনগুলোতে রুগী দেখতে যাবে না, জানাযায় যাবে না, স্ত্রী আলিঙ্গন করবে না, শুধু জরুরী প্রয়োজনে (মসজিদের ) বাইরে যাবে, রোযা থাকবে, জামে মসজিদে ই'তিকাফ করবে [হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত]। রুগী দেখতে যাওয়া এবং জানাযার নামাযে শরীক হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে (ফেকাহ আহমদীয়া)। সহী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, "আঁ হযরত (সঃ) রমযানের শেষ দশদিন ই'তিকাফ করতেন। আল্লাহ্তাআলা তাঁকে ওফাত দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর এ রীতি অব্যাহত ছিল [বর্ণনা-হযরত আয়েশা (রাঃ)]
প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে সাধনার এক অপূর্ব সওগাত নিয়ে প্রতি বছর মাহে রমযান আসে। দৈহিক ও আধ্যাত্মিক তথা সার্বিক কল্যাণের জন্যে রমযানের কৃচ্ছ্রতার মাঝে যে মহান সংকল্প ও শিক্ষা নিহিত তা পূর্ণ বাস্তবায়নের মাঝেই এ মাসের সার্থকতা রয়েছে। নিছক আচার-অনুষ্ঠান ও বাহ্যিকতার মাঝে বিশেষ কোন সার্থকতা নেই।
No comments