যাকাত-২
দু'প্রকারের যাকাত
১. সেসব মালের ওপর যাকাত যা সরকারের কাছে জমা দিতে হয় এবং কোনো ব্যক্তির সেরূপ যাকাত যা গরীবদের মাঝে বন্টন করে দেয়া যায়, জমির ফসলের যাকাত, ব্যবসায় বা কারবারে নিয়োজিত টাকার যাকাত, খনিজ দ্রব্যের ওপর দেয় যাকাত (বা খুমুস) এবং গৃহপালিত পশুর ওপর দেয় যাকাত এ চার প্রকার যাকাত রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দিতে হবে যাতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মিসকীনদের প্রতিপালন এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য খরচ করতে পারে।
২. যেসব মাল বা সম্পদ রাষ্ট্রের পক্ষ হতে নির্ণয় করা সম্ভব নয়, যেমন, গহণা ও অলংকার এবং মজুদকৃত অর্থ-এ বিষয়গুলোর যাকাত দেয়া ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব দায়িত্ব। এসব বিষয়ের যাকাত ইমাম বা খলীফার তত্ত্বাবধানে সংগৃহীত এবং বন্টন হতে হবে। কাউকেও যাকাতের অর্থ দেয়ার যোগ্য মনে করলে তার দরখাস্ত ইমামের সমীপে দেয়া যেতে পারে। খিলাফতের নেযামের মাধ্যমে যাকাত দেয়ার ব্যবস্থা দ্বারা যাকাত গ্রহীতাদের আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে যা, যাকাত দাতার সরাসরি বিতরণে সম্ভব হতো না। দানের হাত ওপরে থাকে আর গ্রহণের হাত নীচে, ফলে দাতার সামনে গ্রহীতা স্বাভাবিকভাবে সব সময় মাথা নীচু করে চলবে, বিশেষ করে ভবিষ্যতে আবার পাওয়ার আশায়। এতে তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু নেযামের মাধ্যমে যাকাত বন্টনে এ ত্রুটি ঘটে না। কারণ গ্রহীতা এটা আল্লাহ্তা'আলার ব্যবস্থায় অধিকার হিসেবে লাভ করেন।
চাঁদা ও যাকাত
জামাতের চাঁদা এবং যাকাত আলাদা আলাদা জিনিস। কারণ কোনো মুসলমানের জন্য মাল (ধন-সম্পদ) কুরবানী শুধু যাকাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং আল্লাহ্তা'আলা তাকে আরও কোন কোন হক্ পূরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) বলেছেন, "তৃতীয় বিষয় হলো জামাতের চাঁদা যা দীনের জেহাদের জন্য প্রয়োজনীয়। এ জেহাদ তলোয়ারে জেহাদ হোক বা কলম ও কেতাবের দ্বারাই হোক, এও প্রয়োজনীয়। কেননা যাকাত এবং সদ্কা গরীবদের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে। এ দিয়ে বই-পুস্তক ছাপানো সম্ভব নয় বা মুবাল্লিগদেরকেও দেয়া যায় না" (মালায়কাতুল্লাহ্, পৃঃ৬২)।
আজকাল তলোয়ারের জেহাদ নেই। সুতরাং ইসলাম প্রচারের জন্যে অথবা জামাতের নেযামের মজবুতির জন্যে এবং এ ধরনের অন্যান্য খরচাদির জন্যে যে টাকা সংগ্রহীত হয় তা-ই চাঁদার অন্তর্ভূক্ত।
(জাহিদূ বিআম্ওয়ালিকুম ওয়া আন্ফুসিকুম)
অর্থ :
তোমরা আল্লাহ্র পথে জেহাদ করো তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের প্রাণ দিয়ে।
(জাহিদূ-তোমরা জেহাদ করো, বি-সহ/দ্বারা, আমওয়াল-ধন-সম্পদ, আনফুসিকুম-তোমাদের প্রাণ)
এ আয়াতের প্রথম অংশের ওপর আমল করা যায় চাঁদা দিয়ে আর দ্বিতীয় অংশের ওপর আমল করা যায় কোন কোন সময় নিজের কাজ স্থগিত রেখে কিছু সময় তবলীগের জন্যে দিয়ে কিংবা দীনের উন্নতির জন্যে তা'লীম ও তরবিয়তের কাজে অংশ নিয়ে।
সূরা বাকারার চতুর্থ আয়াতও এ কথার সমর্থন করে। অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের জন্যে অর্থ-সম্পদ,সময় এবং জ্ঞানের দ্বারা সেবা করতে হবে। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) বলেছেন, "লাযেমী (অবশ্য-দেয়) চাঁদা এবং হিস্সায় আমদ্ (ওসীয়্যতকারীদের আয়ের অংশবিশেষ) যাকাত হতে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বস্তুত যাকাত একটি আলাদা ফরয কাজ। সমস্ত চাঁদা দিলেও যাকাত দেয়া অবশ্য-কর্তব্য। যাকাতের নিয়্যত করে চাঁদা দিলেও যাকাত আলাদাভাবে দিতে হবে" (মাসায়েলে যাকাত, পৃঃ ১০)।
যাকাত আদায় না করার পরিণাম
আল্লাহ্তাআলা কুরআন করীমে বলেছেন :
(ওয়াল্লাযীনা ইয়াক্নিযূনায্ যাহাবা ওয়াল্ ফিয্যাতা ওয়ালা ইয়ুনফিকূনাহা ফী সাবীলিল্লাহ্, ফাবাশ্র্শিহুম বি'আয্বিন্ 'আলীম ; ইয়াওমা ইউহ্মা 'আলায়হা ফী নারি জাহান্নামা ফাতুক্ওয়া বিহা জিবাহুহুম ওয়া জুনূবুহুম্ ওয়া যুহূরুহুম; হাযা মা কানায্তুম লি আনফুসিকুম ফাযূকূ মা কুন্তুম্ তাকনিযূন্)
অর্থ :
এবং যারা সোনা-রূপা মজুদ করে এবং আল্লাহ্র রাস্তার খরচ করে না তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। (সেদিন) যেদিন এগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং এগুলো দিয়ে তাদের কপালে, তাদের পার্শ্বদেশে, এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। (এবং তাদেরকে বলা হবে) এটা সেই বস্তু যা তোমরা নিজেদের জন্যে মজুদ করতে, সুতরাং তোমরা যা মজুদ করতে (এখন) এর স্বাদ গ্রহণ করো (সূরা তাওবা : ৩৪,৩৫)।
(ওয়া-এবং, আল্লাযীনা-যারা, ইয়াক্নিযূনা-মজুদ করে, যাহাবা-স্বর্ণ, ফিয্যাতা-রৌপ্য, লা-না, ইয়ুন্ফিকূনা-তারা খরচ করে, হা-এটা/তা, ফী-মাঝে, সাবীলিল্লালি-আল্লাহ্র রাস্তায়, ফাবাশ্শিরহুম-তাদেরকে সুসংবাদ দাও, 'আযাবিন 'আলীম-যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, ইয়াওমা-যেদিন, নার-আগুন, ইউুহ্মা 'আলায়হা ফী নারি জাহান্নামা-(এগুলোকে) জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, ফাতুকওয়াবিহা-অতঃপর এগুলো দ্বারা দাগ দেয়া হবে, হুম-তাদের, জিবহা-কপাল, জূনুব্-পার্শ্বদেশ, যুহূর-পৃষ্ঠদেশ, হাযা-এ, মা-যা, কানায্তুম-তোমার মজুদ করতে, লি-জন্যে, আনফুস-আত্মাসমূহ, কুম-তোমাদের ফা-অতঃপর,যূকূ-স্বাদ গ্রহণ করো, কুনতুম-তোমরা)
হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, "যে ধনী ব্যক্তি নিজেদের ধন-সম্পদ হতে যাকাত আদায় করে না, তাঁর ধন-সম্পদকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং উত্তপ্ত শলাকা দ্বারা তাদের কপালে এবং মুখ মন্ডলে দাগ দেয়া হবে এবং এ শাস্তির মেয়াদ পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে। "[হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত]
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত হয়েছে, "হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তিকে আল্লাহ্তাআলা ধন-সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে এর যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তার সেই ধন-সম্পদ এক ভীষণ সাপের আকারে দৃষ্ট হবে। উক্ত সাপ কিয়ামতের দিন তার গলায় জড়িয়ে থাকবে এবং চোয়াল দংশন করতে করতে বলবে; আমি তোমার সেই ধন-সম্পদ যার যাকাত তুমি দাও নি" (বুখারী ও মিশকাত)।
অন্য হাদীসে আছে, একদা দু'জন স্ত্রীলোক হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সাথে দেখা করতে আসে। তাদের হাতে দু'টি করে সোনার বালা ছিল। আঁ হযরত (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এ সম্পদের যাকাত দাও? তারা বললো, না। এ কথা শুনে আঁ হযরত (সাঃ) বলেন, তোমরা কি পসন্দ করো কিয়ামতের দিন আল্লাহ্তা'আলা তোমাদেরকে আগুনের বালা পরিধান করান? তারা বললো, কখনই না। আঁ হযরত (সঃ) বললেন; তাহলে তোমরা এ গহণার যাকাত আদায় করো (মেশকাত, তিরমিযী)।
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) অলংকার ও গহণার যাকাত সম্পর্কে বলেছেন, "যে গহণা সর্বদা ব্যবহার করা হয় এর যাকাত দিতে হবে না। এরূপ গহণা যা গচ্ছিত থাকে, কিন্তু কখনো কখনো পরিধান করা হয় এবং কখনো কখনো গরীব স্ত্রীলোকদের ব্যবহার করতে দেয়া হয় এর সম্পর্কে কারো কারো ফতোয়া এই যে, ও গুলোর যাকাত দিতে হবে না। যে গহণা মাঝে মাঝে পরিধান করা হয়, কিন্তু অন্যদের ব্যবহার করতে দেয়া হয় না এর যাকাত দেয়াই উত্তম। কেননা, এ শুধু নিজের জন্যেই ব্যবহৃত হয়। এভাবে আমার গৃহে আমল করা হয় এবং প্রত্যেক বছরের শেষে যাকাত দেয়া হয়। যে গহনা টাকার ন্যায় সঞ্চিত রাখা হয়, এর উপর যাকাত দেয়া সম্পর্কে কোন মতবিরোধ নেই" (মজমুয়া ফাতাওয়া আহমদীয়া, খন্ড-১, পৃঃ১৬৮)
যাকাত দিলে ধন-সম্পদ কমে না
কোন কোন দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তি মনে করেন, যাকাত দিলে ধন-সম্পদ ক্রমশঃ কমে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু আল্লাহ্ই সকল উপজীবিকা বা রিযকের মালিক। আল্লাহ্তা'আলা কুরআন করীমে বলেছেন :
(আশ্শায়্ত্বানু ইয়্যাইদুকুমুল্ ফাকরা ওয়া ইয়া'মুরুকুম বিল্ফাহ্শায়ি ওয়াল্লাহু ইয়ায়িদুকুম মাগফিরাতাম্ মিন্হু ওয়া ফায্লান্, ওয়াল্লাহু ওয়াসি'উন 'আলীম)
অর্থ :
শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং সে তোমাদেরকে অশস্নীলতার আদেশ দেয়, পক্ষান্তরে আল্লাহ্ নিজ পক্ষ হতে তোমাদেরকে ক্ষমা এবং আশিসের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বস্তুত আল্লাহ্ প্রাচুর্যদানকারী 'সর্বজ্ঞ (সূরা বাকারা : ২৬৯)।
(ইয়ায়িদুকুম্-তোমাদেরকে ভয় দেখায়, ফাকরা-দারিদ্র্য, ইয়া'মুর-আদেশ দেয়, ফাহ্শা-অশস্নীলতা, মাগ্ফিরাত-ক্ষমা, ওয়াসি'উন-প্রাচুর্য দানকারী, 'আলীম-সর্বজ্ঞ)
এ আয়াতে আল্লাহ্তা'আলা শয়তানী প্ররোচনা হতে মানুষকে সতর্ক করেছেন। শয়তানী প্ররোচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ যখন আল্লাহ্র পথে খরচ করার জন্যে দারিদ্রের ভয় করে, তখন দারিদ্র্য এবং অশস্নীলতা প্রবলভাবে সমাজ দেহকে জর্জরিত করে ফেলে (সমাজের গরীবদের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দেয়ার জন্যে)। তখন ধনী-দরিদ্র সকলেরই প্েক্ষ জীবন ধারণ করা অসহনীয় হয়ে পড়ে। দারিদ্রতা এবং সামাজিক কদাচার সকলকেই প্রভাবিত করে। এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পূর্বেই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্যে আল্লাহ্র পথে খরচ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
যাকাত ও সুদের তুলনা
যাকাতের মাধ্যমে ইসলাম গরীবদের অবস্থা ভাল করার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেই সাথে তাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মানকে রক্ষা করেছে, কিন্তু সুদ ব্যবস্থা শুধু যে গরীবদের আর্থিক অবস্থাকে অবহেলা করেছে তা'ই নয়, আসলে এ ব্যবস্থার ফলে গরীবরা আরো গরীব হয় এবং ধনীর ধন আরো বৃদ্ধি পায়। মানব সমাজে ধনী দরিদ্রের মাঝে যে বিরাট বৈষম্য রয়েছে এর ফলে সমাজের একটা বৃহত্তম অংশ দারিদ্রের কবলে নিষ্পেষিত এবং মুষ্টিমেয় ধনী-শ্রেণী অপরিমিত সম্পদের প্রাচুর্যে নিমগ্ন রয়েছে, এ সকলের মূলে রয়েছে সুদ-ব্যবস্থা। সেজন্য কুরআন করীমে যাকাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং সুদ গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে
(এর পরিণাম বিবেচনা করে)। আল্লাহ্তা'আলা বলেছেনঃ
(ওয়ামা আতায়তুম্ র্মি রিবাল্ লি ইয়ারবুওয়া ফী আমওয়ালিন্নাসি ফালা ইয়ারবূ ইন্দাল্লাহি; ওয়ামা আতায়্তুম্ মিন্ যাকাতিন্ তুরীদূনা ওয়াজহাল্লাহি ফাউলায়িকা হুমুল মুযইফূন)
অর্থ :
এবং তোমরা যা ( যে অর্থ) সুদের ওপর দিয়ে থাকো তা লোকের ধন-সম্পদের সাথে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এটা আল্লাহ্র সমীপে বৃদ্ধি পায় না; এবং তোমরা আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যে যাকাত দাও-জেনে রাখ যে, এ সকল লোকই (নিজেদের ধন-সম্পদ) বহুগুণে বৃদ্ধি করছে (সূরা রূম : ৪০)
(ওয়ামা আতায়তুম-এবং যা তোমরা দিয়ে থাকো, মির্নারিরা-সুদের ওপরে ইয়ারবুওয়া ফীআমওয়াল্িন্নাসি- তা মানুষের ধন-সম্পদকে বাড়িয়ে দেয়, ফালা ইয়ারবু ইনদাল্লাহি-কিন্তু তা আ্ল্লাহ্র নিকট বাড়ে না, আতায়তুম মিন যাকাতিন-যাকাত থেকে তোমরা দিয়ে থাকো, তুরীদুনা ওয়াজহাল্লাহি-আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, ফাউলায়িকা-অতঃপর তারা, হুমুল মুয'ইফূন-তারা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে।)
মূলধন বা পুঁজি বিনিয়োগ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঋণ-গ্রহণ এবং ঋণ দান। ইসলাম ঋণ দান সম্পর্কিত আদান-প্রদানের ব্যাপারে সুদ-ভিত্তিক অর্থ-ব্যবস্থাকে আদৌ সমর্থন করে নি। কুরআন করীমে সূরা বাকারায় বলা হয়েছে :
(আল্লাযীনা ইয়া'কুলূনার রিবা লা ইয়াকূমূনা ইল্লা কামা ইয়াকুমূল্লাযী-ইয়াতাখাব্বাতূহুশ শায়ত্বানু মিনাল মাসসি; যালিকা বিআন্নাহুম্ কালূ ইন্নামাল বাইয়ু মিসলুর রিবা, ওয়া আহাল্লাল্লাহুল বায়'আ ওয়া র্হারামার রিবা)
অর্থঃ যারা সুদ খায় তারা সেভাবে দাঁড়ায় যেভাবে সেই ব্যক্তি দাঁড়ায় যাকে শয়তান সংস্পর্শে এনে জ্ঞান-বুদ্ধিহারা করে ফেলে, এটা এ কারণে যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয়ও সুদেরই মতো; অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন (সূরা বাকারা : ২৭৬ আয়াতাংশ)।
(আল্লাযীনা-যারা, ইয়া'কুলূনা-তারা খায়, রিবা-সুদ, লা ইয়াকূমু-তারা দাঁড়ায় না, ইল্লা কামা ইয়াকূমুন-তাদের অনুরূপ দাঁড়ানো ছাড়া, আ্ল্লাযী ইয়াতাখাব্বাত্বুহুশ শায়ত্বানু-যাদেরকে শয়তান জ্ঞানবুদ্ধি-হারা করে, মিনাল মাস্সি-সংস্পর্শে এনে, বায়'য়ু-ক্রয়-বিক্রয়, যালিকা-এটা, বিআন্নাহুম-এ জন্যে যে তারা, ক্বালূ-তারা বলে, আহাল্লাল্লাহু-আল্লাহ্ হালাল করেছে, র্হারামা-হারাম করেছেন)
পবিত্র কুরআন সর্বপ্রকার সুদ নিষিদ্ধ করেছে। আধুনিক কালে ব্যবসায়-বাণিজ্য সুদের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সুদ ছাড়া কোন অর্থনৈতিক প্রগতির কথা আপাতঃ দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অর্থ-ব্যবস্থা পরিবর্তন করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে যখন সুদ ছাড়াও ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং শিল্প গড়ে উঠতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সুদহীন অর্থ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উলেস্নখিত ব্যবসায়-বাণিজ্য অপ্রতিহতভাবেই চলেছিল। উপরে উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে যে, শয়তান যাকে উন্মত্ত করে তুলেছে সে ছাড়া কেউই সুদ গ্রহণ করে উন্নতি লাভ করতে পারে না। এ কথার অর্থ এই যে, কোন বদ্ধ পাগল যেমন তার কর্মের পরিণাম ভেবে দেখে না, তেমনিভাবে সুদের ওপরে ঋণদাতাগণ সুদের মারাত্মক পরিণতির কথা ভেবে দেখে না। সুদখোর মহাজনেরা শুধু তাদের নিজেদের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখে, সমাজ তথা দেশ এবং পৃথিবীর পরিণামের কথা ভাবতে পারে না। সুদের নেশায় কোন কোন সময় তাদের মানবোচিত গুণাবলী, যথা, দয়া-মায়া, সহমর্মিতা বিনষ্ট হয়ে যায়। সুদ-ভিত্তিক অর্থ-ব্যবস্থার ফলে কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সাধ্যাতীত ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে একে সুদূর প্রসারী দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। সুদখোর মহাজন বা ব্যবসায়ীরা এত সহজে অর্থ উপার্জন করতে পারায় তারা অর্থ-ব্যবসার মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে। সুদ ব্যবস্থা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে যার ফলে জাতিতে জাতিতে পরস্পরে সহজেই স্বার্থের সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে। যখন যুদ্ধ বাধে তখন বিবদমান জাতিগুলোকে বিদেশ হতে অতিরিক্ত সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করতে হয় এবং সুদের ভিত্তিতে দেশ হতেও বহু অর্থ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। দেশ এবং বিদেশ হতে এভাবে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সহজেই মারণাস্ত্র তৈরী করা অথবা আমদানী সহজেই ব্যাপকতা লাভ করে। ব্যাংকগুলো সুদের অফুরন্ত প্রস্রবণস্বরূপ। এগুলো ছোট-বড় যুদ্ধ ও মহাযুদ্ধের সমরোপকরণ আহরণে সাহায্য করে এবং জাতি-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে মানবতার সর্বনাশ করে এবং বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অচিরেই পবিত্র কুরআন, হাদীস ও হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবী উলট-পালট হয়ে যাবে এবং জগতে মহা ধ্বংস সংঘটিত হবে। তখন "ওসীয়্যতের নেযাম" (ওসীয়্যত ব্যবস্থা) কায়েম হবে ও যাকাতের ব্যবস্থা পৃথিবীতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জগতে শান্তিরাজ্য কায়েম হবে। যারা সুদের ওপর টাকা ধার করে তাদের আত্মমর্যাদাবোধ, বিবেচনাবোধ এবং সতর্কতাবোধ অনেক হ্রাস পায়। কুরআন করীমে সেজন্য এ অবস্থাকে উন্মত্ততা বা পাগলামী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। উলেস্নখিত আয়াতে সুদ-পদ্ধতির সমর্থকদের সাধারণ যুক্তির কথাও আল্লাহ্তা'আলা উলেস্নখ করেছেন। সেসব লোক প্রায়ই বলে যে, লাভের জন্য যেভাবে মানুষ বিভিন্ন দ্রব্যের মাধ্যমে ব্যবসায় করে, একইভাবে অর্থের ব্যবসায় যে মুনাফা পাওয়া যায় একেই সুদ বলে। কিন্তু সুদ ব্যবসায়ের ফলে যেসব অকল্যাণকর পরিণাম দেখা দেয়, অন্য ব্যবসায়ের ফলে সেরূপ ঘটে না।
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) সুদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, "শরীয়তে সুদের সংজ্ঞা এই যে, কোন ব্যক্তি যদি নিজের লাভের জন্য অন্যকে ঋণস্বরূপ টাকা দেয় এবং লাভ নির্দিষ্ট করে নেয়,তাহলে তা সুদ হবে। ..... কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি টাকা নেয় এবং অঙ্গীকার না করে বরং নিজের পক্ষ হতে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে দেয়, তাহলে এটা সুদ বলে গণ্য হবে না। নবীরা যখনই ঋণ গ্রহণ করতেন তখন অবশ্যই অতিরিক্ত টাকাসহ ঋণ ফেরৎ দিতেন" (ফিকাহ আহমদীয়া, ২য় খন্ড)। হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, "যে ঋণ কোন মুনাফা টানে, তা সুদ" (জামেউস সগীর)।
পৃথিবীতে আজ যারা সবচেয়ে বেশি ধনী বলে পরিচিত তাদের প্রায় প্রত্যেকেই সুদ পদ্ধতি সুচতুর প্রয়োগের দ্বারা দ্রুত মূলধনের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। ফলে সামান্য টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে তারা ব্যাংকের বিশ্বাসভাজন হয় এবং পরে একদিকে প্রচুর টাকা ধার নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে এবং অন্যদিকে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে প্রচুর মুনাফা লাভের পথ সৃষ্টি করে। বহুক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীরা বা সাধারণ স্বল্প-মূলধন নিয়োগকারী ব্যবসায়ীদেরকে প্রতিযোগিতায় সহজেই হারিয়ে দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা (গড়হড়ঢ়ড়ষু) প্রতিষ্ঠিত করে। সুদ-ভিত্তিক এ ঋণ প্রথার দক্ষ পরিচালনার সাহায্য ছাড়া শিল্প কিংবা ব্যবসায় কেউ আকাশচুম্বী উন্নতি লাভ করেছে এমন দৃষ্টান্ত অল্পই আছে।
সুদহীন ইসলামী অর্থনীতি
যদি সুদ পদ্ধতি না থাকত তাহলে প্রত্যেকেই তার মূলধন কো-অপারেটিভ বা সমবায়-ভিত্তিক ব্যবসায় বা শিল্পকাজে নিয়োগ করত্ো ফলে ব্যবসায় ও শিল্পের মূলধনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও যেমন বাড়তো তেমনি ব্যবসায়ের আয় বহুলোকের মাঝে বন্টন করা হতো। দশজন লোকের প্রত্যেকে যদি দশ হাজার টাকা কোন ব্যবসায় নিয়োগ করে তবে একলক্ষ টাকা দিয়ে যে ব্যবসায় করা যাবে এর লভ্যাংশে দশজনের সমান অধিকার থাকবে। অথচ সেই একলক্ষ টাকার মালিক যদি মাত্র একজন ব্যবসায়ী হয়, তবে সমস্ত লাভ একমাত্র তারই হাতে যাবে, উভয়ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের পরিমাণ সমান থাকবে। শুধু মুনাফা বন্টনের বিভিন্নতা হবে। সমবায় পদ্ধতির ফলে ব্যবসায়ের পরিমাণ হ্রাস পাবে না, (উত্তম সংগঠনের প্রয়োজন হবে) অথচ মুনাফা কোন ব্যক্তিবিশেষ বা পরিবারের একক হাতে না গিয়ে একাধিক হাতে পড়বে।
এখানে একথা বলা আবশ্যক যে, ইসলাম সুদহীন ঋণ প্রথাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে নি। বরং ঋণ গ্রহীতাকে বলা হয়েছে যে, সে যেন ঋণ গ্রহণের সময় অন্যকে দিয়ে তা লিখিয়ে নেয় এবং শর্তগুলো নির্ধারণ করে দেয় (সূরা বাকারা : ২৮৩)। আবার বলা হয়েছে যে, ঋণ গ্রহীতা যদি কষ্টকর অবস্থায় থাকে, তাহলে ঋণদাতা যেন তাকে কিছু সময় দেয় যতদিন তার সুদিন না আসে আর যদি ঋণ দাতা তাকে অক্ষমতার জন্য মাফ করে দেয় অর্থাৎ ঋণের টাকা গ্রহণ না করে, তা আরও উত্তম বলে আল্লাহ্র নিকট বিবেচিত হবে (সূরা বাকারা : ২৮১)
যাকাত ব্যবস্থা ও অর্থ পরিচালনা
(Money Circulation)
যাকাতের উদ্দেশ্য শুধু দীন-দুঃখীর প্রতি বিশেষ ত্রাণের ব্যবস্থা করা অথবা আর্থিক দিক দিয়ে যারা পশ্চাতে পড়ে আছে সমাজের সে অংশের উন্নয়ন করাই নয় বরং এর দ্বারা অর্থ-সম্পদ এবং পণ্য-দ্রব্য মজুদ করে রাখার অভ্যাস নষ্ট হয়। ফলে টাকা-পয়সা এবং অন্যান্য পণ্য-দ্রব্য সর্বদা এক হাত হতে অন্য হাতে পরিচালিত হতে পারে। এভাবে অতি সহজেই ঊপড়হড়সরপ অফলঁংঃসবহঃ বা আর্থিক বিষয়সমূহের পারস্পারিক সমন্বয় সাধিত হতে পারে। অর্থ-সম্পদ সর্বদা সার্কুলেশনে সচল থাকার ফলে সহজভাবেই বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের কর্মসংস্থান হবে। উপরন্তু যাকাতের টাকা দ্বারা সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মৌলিক চাহিদা গুলোও পুরণ হবে। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
(ওয়াল্লাযীনা হুম্ লিয্ যাকাতি ফা'য়িলূন)
অর্থ :
(মু'মিনরা) যারা যাকাত প্রদানে তৎপর তারা সফল হয়। অর্থাৎ মু'মিনরা যাকাত প্রদানে কোন গড়িমসি করে না (সূরা মু'মিনুন : ৫)।
মোট কথা ব্যক্তিগত, সামাজিক তথা সার্বিক কল্যাণের জন্য যাকাত- ব্যবস্থা সত্যিই অতুলনীয়। সূরা লোকমানের প্রথম রুকূতে সেজন্য বলা হয়েছে, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং পরলৌকিক জীবনে দৃঢ়-বিশ্বাস রাখে, তারাই তাদের প্রভুর তরফ হতে আগত হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে এবং তারাই (সকল ক্ষেত্রে) কৃতকার্য হবে' (সূরা লোকমান : ৫,৬)।
ইসালামী অর্থনীতির মূলকথা
প্রসঙ্গত : ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কয়েকটি মূল বিষয়ের উলেস্নখ করা যেতে পারে।
১. ইসলাম অসঙ্গতভাবে অর্থোপার্জনের প্রচেষ্টাকে ধর্মীয় এবং নৈতিক বিধানের দ্বারা কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
২. অর্থনীতির মূল বিষয় 'অভাববোধ' (Want) সম্বন্ধে ইসলাম একটি নূতন মূল্যবোধের সৃষ্টি করেছে। এ মূল্যবোধে পূঁজিপতিদের চরম স্বার্থান্ধতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা নেই অথবা কম্যুনিজমের অনুপ্রেরণাহীন ও ব্যক্তি স্বাধীনতাহীন জীবন যাত্রার কঠোরতাও নেই। ইসলাম সাধারণ অসাধারণ সব মানুষের স্বাধীনতা এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছে এবং এদের মাঝে এক অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
৩. ইসলাম Consumption বা ভোগের পরিমাণ এবং প্রকারকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতে আদেশ দিয়েছে।
৪. এ সব বিষয় সত্ত্বেও যাকাত, সদ্কা, দান-খয়রাত, উত্তরাধিকার ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামের একটি নিখুঁত ধন-বন্টননীতি অনুসৃত হয়েছে। আন্তরিকতার সাথে এ নীতিগুলো অনসৃত হলে ধনী-শ্রেণীর হাতে আপত্তিকর ও অবাঞ্ছিত পরিমাণে ধন-সম্পত্তি সংগৃহীত হতে পারবে না।
৫. ইসলামী নীতি অনুসারে সকল দরিদ্রের মৌলিক খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের অভাব পূরণের জন্য বিশেষ দায়িত্ব থাকবে রাষ্ট্রের ওপরে।
৬. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংযমপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণ করতে হবে এবং যথাসম্ভব যুদ্ধের সম্ভাবনা হতে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
৭. নেযামে ওসীয়্যত ও তাহ্রীকে জাদীদের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।
No comments