যাকাত-১
যাকাত
|
যাকাতের অর্থ হল মাল বা সম্পদের বৃদ্ধি হওয়া এবং সম্পদকে পবিত্র করা। এটা ইসলামের তৃতীয় রোকন বা স্তম্ভ। এটা এরূপ সদ্কা বা দান যা ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে গরীব এবং অভাবী কে দেয়া হয়। আল্লাহ্তা'আলা কুরআন করীমে বলেছেন-
(ওয়ামা আতায়তুম মিন্ যাকাতিন্ তুরীদূনা ওয়াজ্হাল্লাহি ফাউলাইকা হুমুল মুয'য়িফুন)
অর্থঃ এবং তোমরা আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যে যাকাত দাও-জেনে রাখো যে, এসব লোকই (যারা যাকাত দিচ্ছে নিজেদের ধন-সম্পদ) বহু গুণে বৃদ্ধি করছে (সূরা রূম : ৪০)
(ওয়া-এবং, মা-যা, আতায়তুম্ মিন যাকাতিন্-তোমরা যাকাত হতে দাও, তুরীদূনা- তোমরা ইচ্ছা করো, ওয়াজ্হাল্লাহি-আল্লাহ্র মুখভাতি [সন্তুষ্টি] লাভ করো, ফাউলাইকা-অতঃপর সেসব লোক, মুয'য়িফূন-বহুগণে বৃদ্ধি করছে)।
যাকাত শব্দের অর্থ
যাকাত শব্দের নিম্নলিখিত কয়েক প্রকার অর্থ হয় :
ক. কোন জিনিসের বৃদ্ধি পাওয়া এবং আশীষপূর্ণ হওয়া।
খ. খারাপ অবস্থা হতে উত্তম অবস্থায় উন্নীত হওয়া।
গ. খোসহালী বা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা।
ঘ. 'তাহারাত' লাভ করা বা শুদ্ধ হওয়া।
ঙ. প্রশংসার যোগ্য হওয়া।
চ. উচ্চ পর্যায়ের বস্তু।
ছ. মালের যাকাত দেয়া যাতে সেই মাল পবিত্র হয়।
জ. কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদ্কাকে যাকাত এজন্য বলা হয় যে, এ দেয়ার ফলে মাল বরকতপূর্ণ হয়, বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপদ হতে মুক্ত হয়।
(তফ্সীরে কবীর, সূরা বাকারার ৪৪তম আয়াতের তফসীর দ্রষ্টব্য)
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) বলেন, "ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে গরীবদের দেয়ার নাম যাকাত। এতে উত্তম পর্যায়ের সহানুভূতির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এভাবে মুসলমানেরা সামাজিক বিপদাবলী সামলাতে সক্ষম হতে পারে। এটা আদায় করা ধনীর ওপর ফরয। ফরয না হলেও মানবীয় সহানূভূতির অনুপ্রেরণায় গরীবদেরকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু আজকাল আমি দেখি যে, প্রতিবেশী যদি অভুক্ত থেকে মৃত্যুমুখী হয় তবুও পরওয়া করা হয় না। কিন্তু অধিকাংশ লোক নিজ আরাম-আয়েশের দিকে খেয়াল রাখে। খোদাতা'আলা আমার হৃদয়ে যে কথাটি উদ্রেক করেছেন আমি তা বর্ণনা না করে পারি না। মানুষের মাঝে সহানুভূতি একটি উচ্চাঙ্গের শক্তি বা গুণ। আল্লাহ্তা'আলা বলেন,
(লান্ তানালুল র্বিরা হাত্তা তুনফিকূ মিম্মা তুহিব্বূন)
অর্থ :
তোমরা কখনো পুণ্য অর্জন করতে পারবে না যে পর্যন্ত তোমরা যা ভালোবাসো তা থেকে খরচ না করো (সূরা আলে ইমরান : ৯৩)।
(লানতানালুল বিররা-তোমরা কখনো পুণ্য অর্জন করতে পারবে না, হাত্তা-যে পর্যন্ত না, তুনফিকূ তোমরা খরচ করো, মিম্মা-তা থেকে যা, তুহিব্বূন-তোমরা ভালোবাসো)
"অনেক লোক আছে যারা বাসি এবং নষ্ট রুটিও তরকারি যা কোন কাজে আসে না, সেগুলো গরীবকে দেয় এবং মনে করে আমরা পুণ্যের কাজ করে ফেলেছি। এরূপ ধারণা আল্লাহ্র কাছে মঞ্জুর হয় না" (মজ্মুয়া ফাতাওয়া আহমদীয়া, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬০)।
যাকাতের নির্দেশ
কুরআন করীমে বহু জায়গায় যাকাতের স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এই যে, সব মানুষের ধন-সম্পদ অন্যান্য লোকের সাহায্য নিয়েই উপার্জিত হয়। এ উপার্জনে অনেক সময়ে অন্যের হক্ শামিল হয়ে থাকে। মজুরী হিসেবে অন্যদের হক্ মিটিয়ে দেয়ার পরও ধনীর সম্পদে অন্যদের হক কিছু বাকী থেকে যায়। কুরআনের শিক্ষা এই, দুনিয়ার সব সম্পদ সব মানুষের জন্যে, শুধু কোন ব্যক্তিবিশেষের জন্যে নয়। আল্লাহতা'আলা বলেছেন,
(হুয়াল্লাযী খালাক্বা লাকুম মা ফীল আরযি জামী'আন)
অর্থঃ- তিনিই তো [আল্লাহ্ যিনি] পৃথিবীতে যা-ই আছে সবই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন (সূরা বাকারাঃ ৩০)।
(হুয়া-তিনি, আল্লাযী-যিনি, খালক্বা-সৃষ্টি করেছেন, লাকুম -তোমাদের জন্যে, ফী-মধ্যে, আরয-পৃথিবী, জামী'আন-সবই)
সুতরাং শ্রমিক যখন সম্পদ সৃষ্টি করে তখন মজুরী পাওয়ার পরও সেই সম্পদে শুধু তাদেরই নয় অন্যান্য সব মানুষেরও কিছু না কিছু দাবী থাকে। এ দাবী করার উদ্দেশ্যে অভাবী লোকদের মাঝে বিতরণের জন্য যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনো কোনো যাকাত এ জন্যে দিতে হয় যে, এগুলো সার্কুলেশনে না থাকার জন্য সমাজ পূর্ণ ফায়দা হতে বঞ্চিত হয়। যাকাতের নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, অনেক সময় কোন কোন লোক গরীবদের প্রতি নানা কারণে দৃষ্টি দিতে পারে না বা দেয় না। সেজন্য যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের বাঁচার ন্যূনতম অধিকারকে বিধিবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং "বায়তুল মাল"
হতে তাদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, গরীব লোকদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকেও রক্ষা করার জন্যে শরীয়ত ধনীর নিকট হতে যাকাত, সদকা প্রভৃতির আকারে তাদের হক্ আদায় করতঃ দান করে। অবশ্য যাকাত গরীবদের ওপরে কোনো ইহসান নয়-এটা দানকারীর নিজস্ব মঙ্গলের জন্যে এবং তার মাল শুদ্ধ ও পবিত্র করার জন্য দেয়া আবশ্যক। এজন্য কুরআন করীমে বার বার এসেছেঃ
(ওয়া ইউকিমুনাস্ সালাতা ওয়া ইউতুনায্ যাকা-তা)
অর্থঃ-এবং তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়।
আল্লাহ্তাআলা বলেছেন, "মুমিন পুরুষ ও মু'মিন নারীরা পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখে এবং তারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। এরাই এমন যাদের ওপর আল্লাহ্ অবশ্যই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ মহা-পরাক্রমশালী, পরম প্রজ্ঞাময়। মু'মিন পুরষ ও মুমিন নারীদেরকে আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এমন বাগানসমূহের যাদের নীচে দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত থাকবে, সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে " (সূরা তাওবা : ৭১, ৭২)
আল্লাহ্র পথে খরচ করলে ধন-সম্পদ হ্রাস পায় না বরং বৃদ্ধি পায়। কারণ-আ্ল্লাহ্তাআলা রিযক যা উপজীবিকা (Provisions) বাড়িয়ে দেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী অন্যদের কমিয়ে দেন। তাই আল্লাহ্তা'আলা বলেছেন,
(কুল ইন্না রব্বী ইয়াব্সুর্তু রিয্কা লিমাইঁয়্যাশাও মিন্ ইবাদিহী ওয়া ইয়াকদিরুলাহূ; ওয়ামা আন্ফাক্তুম্ মিন শায়য়িন ফাহুয়া ইউখলিফুহূ; ওয়া হুয়া খায়র্রু রযিকীন)
অর্থ :
তুমি বলো, "নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক স্বীয় বান্দাদের মধ্য হতে যার জন্যে চান রিয্ক (এর ক্ষেত্র) সম্প্রসারিত করে দেন এবং যার জন্যে চান সংকীর্ণ করে দেন। এবং তোমরা যা কিছু খরচ করবে তিনি অবশ্যই এর প্রতিদান দিবেন; প্রকৃতপক্ষে তিনিই সর্বোত্তম রিয্ক দানকারী" (সূরা সাবা :
৪০)।
(কুল-তুমি বলো, ইন্না-নিশ্চয়, রাব্বী-আমার প্রতিপালক, ইয়াব্সুতু - সম্প্রসারিত করে দেন, লি মাইঁ য়্যাশাও- যার জন্য চান,মিন -হতে, ইবাদিহী-তাঁর বান্দারা, ওয়া-এবং, ইয়াকদিরু-সংকীর্ণ করে দেন, লাহু-তার জন্যে, মা-যা, আন্ফাকতুম-তোমরা খরচ করো, শায়্য়িন-যা কিছু, ফাহুয়া-অতঃপর তিনি, ইউখলিফুহূ-এর প্রতিদান দিবেন, খায়রুন-উত্তম)
আল্লাহ্তা'আলা আরো বলেছেন-
(মাসালুল্লাযীনা ইউনফিকূনা আমওয়ালাহুম ফী সাবীলিল্লাহি কামাসালি হাব্বাতিন্ আম্বাতাত্ সাব'আ সানাবিলা ফী কুল্লি সুমবুলাতিম্ মিআতু হাব্বাতিন, ওয়াল্লাহু ইউযা'য়িফু লিমাঁইয়্যাশাও; ওয়াল্লাহু ওয়াসি'উন 'আলীম)
অর্থ :
যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করে, তাদের দৃষ্টান্ত এক শস্যবীজের দৃষ্টান্তের ন্যায়, যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করে এবং প্রত্যেকটি শীষে একশ' শষ্যবীজ থাকে। এবং আল্লাহ্ যার জন্যে চান (এর চেয়েও) বৃদ্ধি করে দেন; নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, সর্বজ্ঞ (সূরা বাকারা : ২৬২)।
(মাসাল-দৃষ্টান্ত, আল্লাযীনা-যারা, ইউনফিকূনা-খরচ করে, আমওয়ালাহুম- তাদের ধন-সম্পদ, ফী-মাঝে, সাবীলিল্লাহ্-আল্লাহ্র পথে, হাব্বাতিন-শষ্যবীজ, আমবাতাত-নির্গত করে, সাব্'আ সানাবিলা-সাতটি শীষ, ফীকুল্লি সুম্বুলাতিন-প্রত্যেকটি শীষ, মিআতুহাব্বাতিন-এক শতটি দানা, ওয়াল্লাহু-এবং আল্লাহ্ ইউযায়িফ-বৃদ্ধি করে দেন, লিমাঁইয়্যাশাও-যার জন্যে চান, ওয়াসি'উন-প্রাচুর্য দানকারী, 'আলীম-সর্বজ্ঞ)
এ ছাড়া আল্লাহ্র পথে অর্থ সম্পদ ব্যয় করলে মানুষ কুরবানীর মাধ্যমে এমন একটা আনন্দ অনুভব করে যাতে তার আত্মা সতেজ হয়, ঈমান বাড়ে এবং মজবুত হয় (সূরা বাকারাঃ রুকূ ৩৬)
যাকাত প্রদানের বরকত সম্বন্ধে বুখারী, এবং অন্যান্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যখনই কেউ হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর কাছে যাকাত নিয়ে উপস্থিত হতেন তখনই তিনি তার নাম ধরে এ প্রার্থনা করতেন, "হে আল্লাহ! এ ব্যক্তি এবং তার বংশধরের ওপর তোমার নেয়ামত নাযিল করো।" সেই ব্যক্তির জন্যে কত অপূর্ব এ নেয়ামত যে, আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা রাসূল করীম (সাঃ)-এর এ দোয়ায় নিজেকে শামিল করে।
যাকাতের শর্ত
প্রত্যেক সুস্থ, বুদ্ধি-সম্পন্ন, প্রাপ্ত-বয়স্ক লোক যে ধন-সম্পদের অধিকারী, যার নিকট নিদির্ষ্ট পরিমাণ সোনা, রূপা, টাকা অথবা ব্যবসার পূঁজি এবং সামগ্রী, গৃহ পালিত পশু সারা বছর জমা রয়েছে তার জন্য যাকাত দেয়া ফরয।
যাকাত হালালভাবে উপার্জিত সম্পদের উপর দেয়া ফরয এবং প্রতি বছর দিতে হয়। যাকাত এ জন্য দিতে হয় যেন আল্লাহ্র সাথে প্রকৃত ভালোবাসা এবং সত্যিকার সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যাকাতে কৃপণতার অভ্যাস দূর হয় এবং জাতির গরীবদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়। যাকাত ধন-সম্পত্তির প্রতি ভালোবাসা ও আসক্তি হতে রক্ষা করে এবং ধর্মকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দেয়ার শক্তি দান করে। আ্ল্লাহ্তা'আলা অর্থশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন :
(খুয মিন আমওয়ালিহিম্ সাদাকাতান তুতাহ্হিরুহুম ওয়া তুযাক্কীহিম)
অর্থ- তাদের ধন-সম্পদ হতে তুমি সদকা (যাকাত) গ্রহণ করো যেন এ দিয়ে তুমি তাদেরকে পবিত্র করতে পারো এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে পারো। (সূরা তওবা : ১০৩)
(খুয্-তুমি গ্রহণ করো, মিন-হতে, আমওয়ালিহিম-তাদের ধন-সম্পদ, সাদাকাতান-সদকা (যাকাত), তুতাহ্হিরু-তুমি পবিত্র করতে পারো, হুম-তাদেরকে, ওয়া-এবং, তুযাক্কী-তুমি পরিশুদ্ধ করতে পারো)
ঋণী ব্যক্তির জন্য যাকাত ফরয নয়। যে বাড়িতে বাস করা হয় এবং যে অলংকার দৈনন্দিন পরিধান করা হয়, এর ওপর যাকাত দিতে হয় না। যার কাছে পুরো এক বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা থাকে অথবা ব্যবসায় টাকা নিয়োজিত থাকে তার ওপর চল্লিশ ভাগের একভাগ (১/৪০) যাকাত দিতে হবে। পুরো এক বছর সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সেই রূপার মূল্যের পরিমাণ বা তার বেশি সোনা থাকলে, তার মূল্যের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। উলেস্নখ্য যে, সাড়েবায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের পরিমাণের চেয়ে কম ব্যবহার্য গহণার ওপর যাকাত দিতে হবে না। এভাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা এর বেশি রূপা থাকলে এর পরিমাণের চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত দিতে হবে। যে সব অলংকার কখনও কখনও পরা হয় এর ওপরেও উলেস্নখিত হিসেবে যাকাত দিতে হবে। চল্লিশটি বকরী থাকলে একটি বকরী, পাঁচটি উটের জন্যে একটি বকরী, ত্রিশটি গাভী বা মহিষের জন্যে একটি বাছুর যাকাত হিসেবে দিতে হবে। যে জমিতে কূয়া অথবা খাল হতে পানি সেচ করা হয় এর উৎপন্ন দ্রব্য হতে বিশভাগের একভাগ এবং যে জমিতে পনি সেচ করতে হয় না এর উৎপন্ন দ্রব্যের দশভাগের একভাগ যাকাত দিতে হবে। যাকাতের টাকা অভাবী মুসলমান, নও-মুসলিমের মনস্তুষ্টির জন্যে এবং ধর্মীয় কাজের জন্যে খরচ করা যায়। বিপদগ্রস্থ ব্যক্তির জন্যে এবং এমন লোক যার নিকট একদিনেরও আহার নেই তাকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। ইমাম বা খলীফার তত্ত্বাবধানে যাকাত সংগ্রহ এবং বিতরণ করতে হবে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে যাকাত বিতরণ করতে পারবে না। তবে যাকে সে দান করতে চায় তার দরখাস্ত খলীফার কাছে প্রেরণ করা যাবে। যাকাত প্রতি বছর আদায় করার মেয়াদ সেই সময় হতে নির্ধারণ করতে হবে যে সময় হতে তার কাছে অর্থ-সম্পদ অথবা গহনা মজুদ থাকে। কেউ নিজের টাকা অন্যকে ঋণস্বরূপ দিলে সেই টাকার ওপর যাকাত দিতে হবে না। কিন্তু উক্ত টাকা ফেরত পাওয়ার পর যাকাত দিতে হবে।
যাদের মাঝে যাকাত বিতরণ করা যায়
কুরআন করীমের শিক্ষানুযায়ী নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণের মাঝে যাকাত বিতরণ করতে হবে (সূরা তওবা : ৬০ আয়াত দ্রষ্টব্য)।
ক) ফকীর-অর্থাৎ এমন লোক যারা দারিদ্র্য অথবা অসুস্থতার কারণে আর্থিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
খ) মিসকীন-অর্থাৎ এমন লোক যাদের কাজ করার সামর্থ্য আছে, কিন্তু কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় বা উপকরণ নেই।
গ) যেসব ব্যক্তি যাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত অথবা যাকাতের হিসাব রাখে অথবা অন্য কোনভাবে যাকাত আদায়ের কাজে নিয়োজিত থাকে।
ঘ) নও-মুসলিম যারা গৃহ হতে বিতাড়িত এবং যাদের অর্থাভাব রয়েছে।
ঙ) যুদ্ধবন্দী, দাস অথবা অন্যলোক যাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তিলাভের সুযোগ দেয়া হয়।
চ) যেসব ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম অথবা তারা ব্যবসায় বা কারবারে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে।
ছ) কোন মহান কাজের জন্যে।
ঞ) যে লোক সফরে অর্থাভাবে আটকা পড়ে গিয়েছে অথবা যারা জ্ঞানলাভের জন্য সফর করছে অথবা সামাজিক কল্যাণ সাধনের জন্য সফর করছে।
বিভিন্ন দ্রব্যের ওপর যাকাতের পরিমাণ (নিসাব) আলাদা আলাদা হিসাব করতে হবে অর্থাৎ সোনার ওপর দেয় যাকাতের হিসেবের সময় শুধু সোনার পরিমাণের কথাই ভাবতে হবে। অনুরূপভাবে ছাগল এবং গাভীর ওপর দেয় যাকাতের হিসেবের জন্য আলাদা আলাদাভাবে যাকাতের হিসাব করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তির নিকট যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা থাকে এবং তিন তোলা সোনা থাকে এবং এর মূল্য সাড়ে বায়ান্না তোলা রূপার মূল্য অপেক্ষা কম হয় তাহলে শুধু রূপার ওপর (রূপার মূল্যের চল্লিশ ভাগের একভাগ) যাকাত দিতে হবে, তিন তোলা সোনার ওপর যাকাত দিতে হবে না। আবার কারো কাছে যদি পাঁচটি উট এবং পাঁচটি গাভী থাকে শুধু উটের জন্য যাকাত দিতে হবে। মোট কথা যাকাতের বিষয়গুলো পৃথকভাবে নিম্নতর পরিমাণ বা সংখ্যা (হিসাব) অতিক্রম করলে যাকাত দিতে হবে।
বিভিন্ন সম্পদের উপর দেয় যাকাতের হিসাব
* উদারহরণঃ যদি কোন ব্যক্তি তার ব্যবসায় প্রথম মাসে ২৫০.০০টাকা, দুইমাস পর ২০.০০ টাকা এবং চার মাস পরে ৫০০.০০ টাকা বিনিয়োগ করে তাহলে বৎসরান্তে তাকে নিম্নলিখিত হিসেব অনুযায়ী গড় ৬০০.০০ টাকার ওপর চল্লিশ ভাগের একভাগ অর্থাৎ ১৫.০০ টাকা যাকাত দিতে হবে।
২৫০.০০ ঢ ১২মাস = ৩০০০.০০টাকা
২০.০০ ঢ ১০মাস = ২০০.০০টাকা
৫০০.০০ ঢ ৮মাস =
৪০০০.০০টাক
--------------------------------
মোট =
৭২০০.০০টাকা
মূলধন বা পূঁজির গড় = ৭২০০/১২=৬০০টাকা
যাকাতের পরিমাণ=৬০০.০০ ঢ (১/৪০)=১৫.০০টাকা
অতএব ৬০০.০০ টাকার উপর দেয় যাকাতের পরিমাণ=১৫.০০টাকা।
যাকাত সম্পর্কিত অন্যান্য নিয়মাবলী
ক) নাবালেগ বা পাগলের সম্পদের যাকাতের জন্য অভিভাবক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খ) বছরের প্রথমে কোনো মালের নিসাব (নিম্নতর পরিমাণ) পূর্ণ না হয়ে যদি শেষের দিকে পূর্ণ হয় তবে শেষের মালের ওপর যাকাত দিতে হবে।
গ) বছরের মাঝে কোনো সময়ে মাল সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে গেলে এবং দ্বিতীয়বার পুনরায় সেই মাল তৈরি হয় তাহলে যখন হতে দ্বিতীয় বার মাল তৈরি হয়েছে তখন হতেই বছর ধরা হবে।
ঘ) বছরের মাঝে কোনো সময়ে মাল চুরি বা লুন্ঠিত বা দখলচ্যুত হলে এবং কোনো কারণে সেই মাল পুনরায় ফেরত পাওয়া গেলে বছরের শেষে তারও যাকাত দিতে হবে।
ঙ) কোন ব্যক্তি বছরের মাঝে কোন মাল অন্য ব্যক্তির সাথে বিনিময় করলে উভয় ব্যক্তির যাকাতের মালের তারিখ বিনিময়ের দিন হতে শুরু হবে।
চ) চান্দ্র মাসের হিসেবে বছর গণনা করতে হবে। সেই মাস হতে বছর শুরু হয়ে যায় যখন হতে কোনো নিসাব পরিমাণ মাল অধিকারে আসে এবং বার চান্দ্র মাস অতিবাহিত হয়।
যে সকল ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে না
ক) ঋণ স্বরূপ প্রদত্ত অর্থ বা সম্পদ।
খ) অন্যের নিকট হতে যে অর্থ এখনও পাওয়া যায় নি (যেমন- কোন দোকানদার তার খরিদ্দারের নিকট বাকীতে মাল বিক্রয় করলে)।
গ) বন্ধক রাখা জিনিস।
ঘ) সরকারের নিকট আমানত হিসেবে প্রদত্ত টাকা।
ঙ) বন্ধকের বিনিময়ে দেয়া টাকা।
চ) কারখানা বা কারবারের প্রদত্ত জামানত।
ছ) মোহরানার টাকা যা স্ত্রী এখনও নগদ পায় নি।
জ) প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত অর্থ।
ঝ) অপহৃত বা হারানো মাল বা টাকা।
ঋণী ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয নয়, কিন্তু ঋণ যদি অল্প হয় এবং তার নিকট এমন সব মাল থাকে যার ওপর যাকাত দেয়া জরুরী তাহলে তাকে নিসাব অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে। অনেকে মনে করেন যে, কোন মালের ওপর যাকাত দেয়ার সময় উপস্থিত হলে আগামী বছরের খরচ পত্রের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা বা মাল বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অংশের ওপর যাকাত দিলেই চলে, এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। সমস্ত সম্পদ বা মালের ওপর যাকাত দিতে হবে। যে মাল যাকাত বা সদকা হিসেবে কাউকে দেয়া হয় তা পুনরায় কিনে ফেরত নেয়া উচিত নয়। যে দেশে নিয়মিত সরকার আছে যা অধিকাংশ যাকাতযোগ্য আয় এবং সম্পদের ওপর ট্যাক্স আদায় করে সেখানে যদিও 'যাকাত' শব্দ ব্যবহার করা হয় না, তবুও তাদের মাঝে অধিকাংশ ট্যাক্সই যাকাতের স্থলাভিষিক্ত, যেমন-জমির খাজনা, আয়কর ইত্যাদি। সুতরাং যে মালের ওপর সরকার ট্যাক্স আদায় করে সেগুলোর ওপর যাকাত দিতে হবে না। কিন্তু যে মালের ওপর ট্যাক্স দিতে হয় না, অথবা যেসব মালের ওপর সরকারী ট্যা যাকাতের নির্ধারিত হার হতে কম, সে অবস্থায় যাকাতের সর্বমোট অংক হতে ট্যাক্স বাবদ প্রদত্ত টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকা যাকাতস্বরূপ আদায় করা উচিত।
যাকাতের হকীকত বা তত্ত্ব-কথা
কুরআন করীমে অর্থ ব্যয়ের কয়েক প্রকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে-এগুলো নিম্নরূপঃ
১. যাকাত-এটা ফরয বা অবশ্য দেয়।
২. সদ্কা-এটা নফল। এর পরিমাণ মানুষের অভ্যন্তরীণ তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্ণয় করার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। দু'প্রকার ব্যক্তি সদ্কা পাওয়ার যোগ্যঃ (ক) যারা নিজেদের প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে সাহায্য চায় এবং (খ) যারা নিজেদের প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে না অথবা যারা প্রকাশ করতে অক্ষম।
৩. সে সব খরচ যা জাতির বা ধর্মের সমষ্টিগত প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়।
৪. শোক্রানা।
৫. ফিদিয়া।
৬. কাফ্ফারা।
৭. সহযোগিতামূলক খরচ যা নাগরিক জীবনের প্রয়োজনের জন্য জরুরী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৮. হাক্কুল খিদ্মত বা পারিশ্রমিক।
৯. আদায়ে ইহ্সান ও উপকারের বিনিময়।
১০. তোহ্ফা বা উপহার
এ দশ প্রকার খরচের কথা কুরআন শরীফ হতে সাব্যস্ত হয়। কেউ এ খরচগুলোর (যেখানেই এর সুযোগ ঘটে) কোনো একটিকে বাদ দিলে নিম্নোক্ত আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী সে আমল হতে বঞ্চিত হয়।
(ওয়া মিম্মা রাযাক্নাহুম ইউ্ন্ফিকূন)
অর্থ :
আমরা তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।
এর ফলে তাক্ওয়ায় দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। দুনিয়াতে অনেক লোক এ শ্রেণীবিভাগকে বিবেচনা না করার জন্যে উত্তম পুণ্য বা সওয়াব হতে বঞ্চিত থাকে (তাফ্সীরে কবীর সূরা বাকারার চতুর্থ আয়াতের তফ্সীর দ্রষ্টব্য)।
No comments