হজ্জের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা





হজ্জের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা

হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) তাঁর বিখ্যাত "তফসীরে কবীর"-এ সূরা হজ্জের যে দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন নিম্নে এর অংশ বিশেষের ভাবার্থ প্রদান করা হলোঃ

"আল্লাহ্‌তাআলা বলেছেন, আমি ইব্রাহীমকে এটাও বলে দিয়েছিলাম যে, এ হুকুম শুধু তোমার জন্যেই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যে। লোক দূর দূর হতে আগমন করবে আর এভাবে সমগ্র দুনিয়ায় একটি মাত্র ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকে সুগম করবে। লোকেরা কুরবানী করার পর গোসল করে নিজেদের দেহের মলিনতা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অন্তরকেও পরিষ্কার করবে এবং তারা আল্লাহ্‌র সাথে যে ওয়াদা করেছিল তা পূর্ণ করবে ও এ পুরাতন গৃহের তোয়াফ করবে। এতে যেন কেউ এ কথা না বুঝেন যে, এ প্রাণহীন বস্তুকে খোদার তুল্য সম্মান প্রদান করা হয়েছে। তোয়াফ একটি প্রাচীন পদ্ধতি, যা কুরবানীর প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কোন লোক অসুস্থ হলে তার চারদিকে তোয়াফ করা হতো, যার উদ্দেশ্য ছিল রোগাগ্রস্থ ব্যক্তির পরিবর্তে তোয়াফকারী নিজের জীবন কুরবানী করতে চায়। আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যুগে যুগে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যারা এ গৃহের সম্মান এবং আল্লাহ্‌তাআলার ইবাদতকে কায়েম রাখার জন্য নিজদের জীবন উৎসর্গ করবে। অন্যথায় বাহ্যিক ভাবে এ তোয়াফের কোন মূল্য নেই।

সূরা হজ্জের বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ্‌তাআলা ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত হজ্জের উলেস্নখ করে বলেছেন, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতি, অসংখ্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং নানা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও মক্কায় একত্র হয়ে এ সত্যেরই সাক্ষ্য প্রদান ক'রে থাকে যে, তাদের মাঝে বর্ণ, গোত্র ও ভাষার শত শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামের তৌহীদ-মন্ত্র তাদেরকে একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। সমবেত মুসলিমরা তাদের কর্ম দিয়ে এটিও প্রমাণ করবে, এ কা'বা গৃহের হেফাযতের জন্য তারা সদা প্রস্তুত এবং কোন শক্তিই কা'বার বিনাশ ও মুসলমানের একতাকে নষ্ট করতে সক্ষম নয়। সমবেত জনতা দুনিয়ার কোন্‌ কোন্‌ প্রান্তে ইসলাম প্রচার লাভ করেছে শুধু তাই দেখে ক্ষান্ত হয় না, বরং এক অনাবাদ ও অনুর্বর অঞ্চল হতে একদিন যে ধ্বনি উত্থিত হয়েছিল, শত বাধা ও বিপত্তিকে অতিক্রম করে তা আজ দুনিয়ার সুদূর প্রান্ত হতে লক্ষ লক্ষ লোককে এনে একত্র করে দিয়েছে দেখে নিজেদের ঈমান তাজা করে।

যেখানে রসূলে করীম (সাঃ)-এর জন্ম ও কর্মভূমি ছিল, যেখানে এককালে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌' বাক্য উচ্চারণ করার অনুমতি ছিল না, আজ সেখানে লক্ষ কন্ঠে 'আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ ওয়াল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল্‌ হামদ' ও ' লাব্বায়িকা লা শারীকা লাকা' উচ্চ আওয়াজে ধ্বনিত হচ্ছে। প্রতি বছর অগণিত লোক সমবেত হয়ে জীবন্ত ধর্ম ইসলামের এবং রসূলে করীম (সাঃ)-এর সত্যতা প্রমাণ করছে। হজ্জের প্রকৃত আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হলো সকল প্রকার সম্পর্ককে ছিন্ন ও চূর্ণ করে একমাত্র আ্‌লাহ্‌তাআলার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা। তাই এ উদ্দেশ্যকে বাস্তবে সার্থক করে তোলার জন্যে ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পার্থিব সব কিছুকে পরিত্যাগ করে মক্কা মুর্কা‌রমায় উপস্থিত হয় এবং এভাবে জন্মভূমি প্রিয়-পরিজন ও সহায়-সম্পদকে কুরবানী করার শিক্ষা গ্রহণ করে। সমস্ত্ত পার্থিব বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করাই হজ্জের প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাই যদি কেউ স্বপ্নে হজ্জ করতে দেখে তা হলে এর তা'বির (ব্যাখ্যা) হলো, উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়া আর মানব জন্মের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহ্‌র ইবাদত করা। তাই হজ্জ মানব জন্মের উদ্দেশ্যকে সফলতা দান করতে সাহায্য করে। হজ্জ সম্পন্ন করতে গিয়ে ও অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক হাজী চার হাজার বছর পূর্বের হযরত ইব্রাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও হাজেরার নজীর বিহীন ঐশী-প্রেম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার অপূর্ব দৃশ্যকে মানব নেত্রে দর্শন করে নিজেদেরকে তদরূপ গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করে। আল্লাহ্‌র রাস্তায় নিঃশেষে সবকিছু দান করলে তাতে ক্ষয় হয় না, জয় ও অমরত্ব লাভ করা যায়। হজ্জ তা জ্বলন্ত ও জীবন্ত করে তুলে ধরে।

হজ্জের আর একটি প্রধান শিক্ষা হল মুসলমানদের অন্তরে কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা সৃষ্টি করা। ইসলামের মূল কেন্দ্রে একত্র হয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত বিশ্বাসী ভাইয়েরা একে অপরের সমস্যাকে উপলব্ধি করার এবং একে অপরের সৌন্দর্যকে দর্শন করে নিজেদের জীবনকে উৎকৃষ্ট আদর্শে রূপায়িত করে বিশ্ব-শান্তির পথকে সুগম করার সুযোগ লাভ করে।

No comments

Powered by Blogger.