চাকরি ছাড়ার সমস্যা


চাকরি ছাড়ার সমস্যা
চাকরি পাওয়া মানেই জীবনের সব চাওয়ার প্রাপ্তি নয়। চাকরি পাওয়ার পরেও একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হতে পারে এই চাকরিটি আপনার জন্য উপযুক্ত নয়। আবার এর চাইতে আরও বড় সম্ভাবনাও অপেক্ষা করতে পারে আপনার জন্য। তাই চাকরির জন্য ব্যস্ত হওয়া যেমন ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তেমনি চাকরি ছাড়াটাও ক্যারিয়ারের টার্নিংয়ের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই অবশ্য বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত দ্বিধায় থাকেন। এই লেখায় চাকরির ছাড়ার নানা দিক নিয়ে লিখেছেন সানজিদা সুলতানা

কাজের জগতে এমন একটা ধারণা প্রচলিত যে কর্মীরা আসলে প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে যান না, তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ত্যাগ করতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটই তার প্রমাণ। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থনীতির মন্দা এখনও না কাটলেও সেখানে প্রতি মাসে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। সেখানে এক জরিপে দেখা গেছে, চাকরিজীবীদের ৭৪ শতাংশই কাজ নিয়ে অসুখী। আর ৩১ শতাংশ এর কারণ হিসেবে বলেছেন, তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পছন্দ করেন না। ৩৫ শতাংশ মানুষ দায়ী করেছেন অফিসের ভেতরের রাজনীতিকে। আর সবচেয়ে বেশি, অর্থাত্ ৪৩ শতাংশ বলেছেন স্বীকৃতির অভাবের কথা।

বাংলাদেশেও এ চিত্র খুব একটা পৃথক নয়। অনেকেই অফিসে এমন অনেক কৃতিত্বের সাথে কাজ করে থাকেন, যার কৃতিত্ব শেষ পর্যন্ত চলে যায় বসের হাতে। নিজের এই স্বীকৃতি না মিললে কাজের উত্সাহ হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে একটি অফিসে কাজ করে গেলেও সেখানে তার বেতন-ভাতার উন্নয়ন সময়ের সাথে চাহিদা অনুযায়ী বাড়ে না। এটাও মানসম্মত কাজের অন্যতম প্রধান একটি অন্তরায়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পুরোনো অফিসকে আঁঁকড়ে ধরে রাখাটা খুব একটা কাজের কথা নয়। কারণ এতে করে নিজের কাজের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন হয়। তাই চাকরি বদলানোটাকে সবসময়ই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে চাকরিটা বদলানোই বরং অনেক বেশি কার্যকর পদক্ষেপ।

কেন ছাড়বেন চাকরি
কর্মীদের অফিসে কাজ কার কিংবা অফিস বদলানোর বিষয়টি সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন করতে পারেন একটি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সকলেই আসলে সহজে চাকরি বদলাতে চান না। মনের মতো পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা পেলে একজন একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় কাজ করতে চান। তবে বাংলাদেশে চাকরি ছাড়ার পেছনে যথেষ্ট বেতন না পাওয়াটা বড় কারণ হিসেবে দেখা যায়। আর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বলা যায়, ক্যারিয়ারে আর এগোনোর সুযোগ না থাকাটা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকা, নিজের কাজ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং না হওয়া, নতুন কিছু শেখার সুযোগ না থাকা, বেতন-ভাতা কম হওয়া, ব্যক্তিজীবনের সাথে কর্মজীবনের সমন্বয়হীনতা—এগুলোই আমাদের দেশে চাকরি ছাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে মন্তব্য তাদের। মেয়েদের জন্য অবশ্য মাতৃত্বকালীন সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন সময়ে অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন না পেলে তাদের চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গত্যান্তর থাকে না।

চাকরি ছাড়ার আগে
তবে আজ বসের ওপর রাগ করে কালকেই চাকরি ছেড়ে দিলাম, এটাও ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক কিছু নয়। বেতন মনোপুত না হলে চাকরি বদলানোটা জরুরি, কিন্তু পুরোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, সেটা পূর্ণ করার পরেই। আসলে চাইলেই একটি চাকরি ছেড়ে দেওয়া ভালো লক্ষণ নয়। চাকরি ছাড়ার আগেও বেশকিছু বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।

প্রথমত, নতুন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ আছে কি না; কাজের দায়িত্ব বৃদ্ধি, উন্নতির সুযোগ আছে কি না তা জেনে নেওয়া জরুরি।

দ্বিতীয়ত, নতুন প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট সম্মান পাবেন কি না এবং সেখানে পরিবেশ নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই হবে কি না তাও জেনে নিন।

তৃতীয়ত, বেতনের বাইরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দেখে নেওয়া উচিত। যেমন, কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন বেশি দিলেও অবসর ভাতা, বিনোদন ভাতা এসব হয়তো খুব কম দেয়। তাই পুরোটা জেনেই তারপর সিদ্ধান্ত নিন।

চতুর্থত, যে প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন তার সুনাম কেমন। ব্র্যান্ড হিসেবে নতুন প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী কি না, সেটিও জেনে নিন।

পঞ্চমত, নতুন প্রতিষ্ঠানে আপনি কি যথেষ্ট মূল্যায়ন পাবেন? তা না পেলে সেটা কিন্তু আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না।

চাকরি ছাড়ার প্রতিবন্ধকতা
আমাদের দেশে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা পদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে চাকরির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়ে থাকে অনেক কঠিন। অনেকের ক্ষেত্রেই তাই শেষ পর্যন্ত কোনো একটি চাকরিই মুখ্য হয়ে পড়ে। ফলে স্বল্প বেতন এবং অফিস প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়েই শুরু করতে হয় ক্যারিয়ার। নতুন চাকরিক্ষেত্রে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে গেলেও অনেকক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট হতে বিরূপ ব্যবহার পেয়ে থাকে তারা। আর মূল্যায়নটাও হয় কম। আবার চাকরির নিয়োগ পত্রে উল্লেখিত কাজের দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করার বিষয়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত ব্যক্তিদের বেতন বৃদ্ধি না করায় বিভিন্ন ব্যক্তি চেষ্টা চালিয়ে যায় নিজ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পছন্দনীয় চাকরি অর্জনে। এমন পরিস্থিতিতে নিজ মেধা, যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে যখন এখনকার চাইতে অনেক ভালো এবং নিজের পছন্দনীয় চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ আসে, তখন চাকরিরত প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে অনেকক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় মেধাবী তরুণদের। ফলে চাকরি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পাশাপাশি সম্মুখীন হতে হয় বিব্রত অবস্থার। অনেক প্রতিষ্ঠানই স্বল্প বেতনে কর্মরত ব্যক্তিদের পাশাপাশি যোগ্যতাসম্পন্ন ও সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভ করার বিষয়টিকে ভালভাবে গ্রহণ করে না।

যেভাবে মোকাবেলা করবেন
চাকরি ছাড়তে গেলে কিছু প্রতিবন্ধকতা আসবে, সেটা মাথায় রেখেই নতুন চাকরির সন্ধান করুন বা নিজের মতো করে কোনোকিছু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। আর কিছু সতর্কতাও অবলম্বন করতে হবে, যাতে চাকরি ছাড়তে গেলে আসা প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করতে পারেন।

চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের শর্তানুযায়ী সময়ের পূর্বেই প্রতিষ্ঠানকেই অবহিত করুন আপনি চাকরিটি ছাড়তে চান।

যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানে আপনার দায়িত্বে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক কাগজসমূহ আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যাস্ত করুন।

প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় অর্থের লেনদেন করতে হওয়ায় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার পূর্বে অর্থসংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পত্তি করুন।

আপনি কেন বর্তমান নতুন প্রতিষ্ঠানে যেতে চান, সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন। নতুন প্রতিষ্ঠানে বাড়তি কী সুবিধা পাবেন, সেটা সরাসরি শেয়ার করুন।

আপনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত কর্মরত প্রতিষ্ঠানের সমস্ত নিয়ম পালন করেই নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ব্যবস্থা করা।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই চাকরি হতে ইস্তফা দেওয়া উচিত।

আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি হতে ইস্তফা দিতে হবে।

এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে চাকরি ছাড়তে গেলে আর আপনার পুরোনো প্রতিষ্ঠান ঝামেলা করতে পারবে না। তাই নিয়ম মেনে কাজ করুন, জয় করুন প্রতিবন্ধকতা।

No comments

Powered by Blogger.