চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্যাতিত ইতিহাস
চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্যাতিত ইতিহাস
--------------------------------------
চীন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। চীনের মোট জনসংখ্যার ২% জনগোষ্ঠী মুসলমান। সংখ্যায় যা ২কোটি ৩০ লক্ষের কাছাকাছি। চীনের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৫টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে দশটি গোষ্ঠীই প্রধানত সুন্নি মুসলিম। তন্মধ্যে উইঘুর, হুই, কানসু মুসলিম সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য।
চীনে ইসলামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। প্রায় ১৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো। প্রসিদ্ধ সাহাবি সা'দ ইবনে আবি ওক্কাস , হযরত সাইদ, ওহাব ইবনে আবি কাবাসা রা. তাদের মাধ্যমে ৬৫০ সনে সাম্রাট গাওজংগের শাসনামলে ইসলামের সাথে চীনের প্রথম পরিচয় ঘটে। যা পরবর্তীতে সিল্ক রোডের বদৌলতে দিন-দিন প্রচার-প্রসার ঘটে।
চীনা মুসলিমদের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হচ্ছে উইঘুর মুসলিম।এরা চীনের মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেক। সংখ্যায় প্রায় ১কোটি ২০ লক্ষের মত। চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ জিনজিয়াং তাদের আদি আবাসভূমি। জিনজিয়াং প্রদেশের সংখাগরিষ্ট ৫৮% জনসংখ্যা এরাই।
উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এরা তুর্কি ও আরবি প্রভাবিত। উইঘুরুদের বর্ণমালাও আরবি। মূলত, এরা মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিনস্ত স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে।মূলত, ৯৬ হিজরী সনে 'উমাইয়া' বংশীয় শাসক ওয়ালীদ বিন আবদুল মালিকের যুগে বিখ্যাত মুসলিম বীর, সেনাপতি কুতাইবাহ বিন মুসলিমের হাতে পূর্ব তুর্কিস্তানের ঐতিহাসিক শহর 'কাশগড়' বিজয় হয়। পরে মধ্যযুগে তাং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকেই সেখানে ইসলাম ও আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে। স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সিল্ক রোড দিয়ে বানিজ্যের জন্য চিনে আসা আরব মুসলিম ব্যাসায়ীর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে পরে উইঘুরের পুরো জনগোষ্ঠীই ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হয়।
১৮৮৩ সালের আগ পর্যন্ত উইঘুরুরা তাদের নিজ দেশ ইসলামি সালতানাতের অধিনে পূর্ব তুর্কিস্তানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিলো। বিপত্তি ঘটে ১৮৮৪ সালে। চীনা কিং রাজত্বের প্রভাবশালী জেনারেল ঝু ঝাংয়ের নেতৃত্বে পূর্ব তুর্কিস্তানকে চিনারা নিজের দখলে নিয়ে নেয়। এবং এর নাম পাল্টে জিনজিয়াং রাখা হয়। যার অর্থ 'নতুন ভূখণ্ড'। পরে ১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে পুরদস্তুর চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দু'বার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেন। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা মাও সে তুংয়ের চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হন, আর পূর্ব তুর্কিস্তানে কমিউনিস্ট আশ্রিত উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে।
ঐতিহাসিকভাবে জিনজিয়াং চীনের কোন অংশ না। এটি যেমন চিনের মহাপ্রাচিরের বাইরে, ঠিক তেমনই এটি Jade gate (জেড ফটক)এর পশ্চিমে। কিন্তু জিনজিয়াং এর ভৌগলিক গুরুত্ব অপরিসীম, এই প্রদেশ চিনকে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করেছে। চিনের উচ্চাভিলাষী ট্রিলিয়ন ডলারে প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড (নতুন সিল্ক রোড) জিনজিয়াং প্রদেশের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ তেল, গ্যাস, তামা, হিরা, কয়লা, সুনায় প্রদেশটি ভরপুর। চিনের মোট জাতীয় চাহিদার ৮০% এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে পূরণ হয়।
এই কারণে চীন জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে নিজের করতলে রাখতে চাইছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীন এখানে জুলুমের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। ৩৯ টি বন্দী শিবিরে ও অসংখ্য ছোট-বড় ক্যাম্পে ১০ লক্ষেরও অধিক স্থানীয় উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখে অসহনীয় মাত্রায় নির্যাতন চালাচ্ছে। এসব ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন এরকম 'ওমির' নামের একজন উইঘুর মুসলিমের সাথে কথা বলতে পেরেছে বিবিসি।ওমির নামের ঐ ব্যাক্তি বলেছেন, "তারা আমাদের ঘুমাতে দেয়নি। কয়েক ঘণ্টা ধরে আমাকে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো হতো। কাঠ ও রবারের লাঠি দিয়ে পেটাতো। তার দিয়ে বানানো হতো চাবুক। সুই দিয়ে শরীরে ফুটানো হতো। প্লাইয়ার দিয়ে তুলে নেওয়া হতো নখ। আমার সামনে টেবিলের ওপর এসব যন্ত্রপাতি রাখা হতো। এসময় অন্যরা যে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতো সেটাও আমি শুনতে পেতাম।"
১৯৪৯ সালের হিসাব অনুযায়ী পূর্ব তুর্কিস্তানের ৯৩% জনসংখ্যা ছিল উইঘুর বা তুর্কি মুসলিম। কিন্তু এ সংখ্যা কমে ৯৩ % থেকে বর্তমানে ৫৮% এ নেমে এসেছে। চিনা কমিউনিস্টদের নির্যাতন ও হানদের অগ্রাসী মনোভাবের ফলে দিন দিন উইঘুর মুসলিমরা তাদের সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয় হারিয়ে ফেলছে। কালের অথৈ গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে।
আগেও বলেছি ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব তুর্কিস্তান কখনোই চীনের অংশ ছিল না। বরং এই ভূমিকে 'হান' চীনারা উপনিবেশে পরিণত করেছে।যেমন ভাবে ব্রিটিশরা আমাদের উপমহাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করেছিল। এই ভূমির অবস্থান চীনের মহা প্রাচীরের বাইরে। আমরা জানি, চীনের মহা প্রাচীর ছিল চীনের সীমানা নির্ধারক স্থাপনা যা বহিঃশত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে চীনারা নির্মাণ করেছিল। পূর্ব তুর্কিস্তান যেমনি চীনের প্রাচীরের বাইরে, ঠিক তেমনি Jade Gate (জেড ফটক) এর পশ্চিমে। সুতরাং ইতিহাস সাক্ষী, কস্মিনকালেও পূর্ব তুর্কিস্তান চীনের অংশ ছিল না। তাই, শুধুমাত্র পূর্ব তুর্কিস্তান নাম পরিবর্তন করে জিনজিয়াং/ সিংকিয়াং (অর্থ- নতুন রাজ্য) রাখলেই অতীত ইতিহাস বদলে যাবে না। জিনজিয়াং অচিরেই সময়ের ব্যবধানে আবারো মুসলিদের করতলে আসবে। ইসলামের বিজয় নিশান কাশঘরের হাজারো তালাবদ্ধ মসজিদের মিনারায় পতপত করে উড়বে ইনশাআল্লাহ।
.
Cltd
সূত্র : মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন, বিবিসি, আল-জাজিরা সহ অন্যান্য গণমাধ্যম।
No comments